Image description

আল জাজিরার মতামত প্রতিবেদন

সম্প্রতি ইউক্রেনের দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষ বলেছে, দেশটির জ্বালানি খাত থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের একটি ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ঘনিষ্ঠজনেরা জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

এ মামলার তদন্ত করছে ইউক্রেনের জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী ব্যুরো (ন্যাবু), যা পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। তদন্তে নাম এসেছে জেলেনস্কির ব্যবসায়িক অংশীদার টিমুর মিনদিচ ও দুই মন্ত্রীর। এমনকি প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ আন্দ্রি ইয়ারমাকের নামও উঠে এসেছে বলে কিছু ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা গণমাধ্যম জানিয়েছে।

তদন্তের ধরন—ধীরে, নাটকীয়ভাবে ও কৌশলগত উপায়ে—অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মনে করছেন। এতে বলা হচ্ছে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নয়, বরং এটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক উপায়।

এই কেলেঙ্কারির ফলে জেলেনস্কির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। ইউক্রেনের অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট এখন আর স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। অনেকেই মনে করছেন, তিনি এখন অন্য কারও—সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশনায় চলছেন।

এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় ফেরার সিদ্ধান্ত নজরে এসেছে। ১১ নভেম্বর ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য টাইমস’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইউক্রেনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই কিসলিতসা বলেছেন—মস্কোর সঙ্গে সংলাপ বন্ধ রাখা হয়েছে, কারণ তাতে কোনো ফল আসছিল না। অথচ এর ঠিক এক সপ্তাহ পর জেলেনস্কি নিজেই জানান, তিনি আলোচনার পথ আবার চালু করতে চান।

এমন সময়ই সামনে আসে এক মার্কিন শান্তি পরিকল্পনার খসড়া। তা যদি সত্য হয়—তবে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রধান দাবিগুলো মেনে নিতে হতে পারে। যদিও কয়েকজন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা কিছুটা প্রতিরোধমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, তবে জেলেনস্কি সরাসরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগের পর তিনি আর আগের মতো স্বাধীনভাবে কঠোর অবস্থান নিতে পারছেন না।

আজ শান্তির আশা তাই কিছুটা বাস্তব মনে হচ্ছে, কারণ ইউক্রেনের সম্ভাব্য পরাজয়ের দায় এখন কেউ একজনের ওপর চাপানো সম্ভব—তিনি হলেন প্রেসিডেন্ট নিজেই।

গত বছর ট্রাম্প যে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন, তা ফলপ্রসূ হয়নি, কারণ তখন কেউই এমন পরিণতির দায়িত্ব নিতে চাননি, যা যুদ্ধের উন্মাদনায় ডুবে থাকা নেতাদের মুখে চপেটাঘাত হতো। এখন যদিও সামরিকভাবে হার মানা মানে কিয়েভের জন্য বাঁচার সুযোগ, কিন্তু এটি পশ্চিমা সমর্থনকারী রাজনীতিক ও লবিস্টদের জন্য বড় ধাক্কা।

এই পুরো যুদ্ধে পশ্চিমা নীতির ভিত্তিই ছিল—রাশিয়ার ওপর চাপ দিয়ে যুদ্ধজয়ের কল্পনা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেই কৌশল এখন আর কাজ করছে না। নিষেধাজ্ঞার ১৯টি ধাপ পার হলেও রাশিয়ার সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী ও আধুনিক হয়েছে।

অন্যদিকে ইউক্রেন সংগ্রাম চালাচ্ছে সৈন্য সংকট, অর্থনৈতিক ভরাডুবি ও এলাকা হারানোর মতো সমস্যায়। শোনা যাচ্ছে, এপ্রিলের মধ্যেই পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইউরোপের ঘনিষ্ঠ মিত্র—যেমন পোল্যান্ড ও জার্মানি ইতোমধ্যে সংকেত দিয়েছে, তারা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের খরচ আর বহন করতে পারবে না।

ইউরোপে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু এই পরিণতির দায় কেউ নিতে চায় না।

এই পরিস্থিতি ট্রাম্পের জন্য খুব একটা চাপের নয়। তিনি তো অনেক আগে থেকেই এটিকে ‘বাইডেনের যুদ্ধ’ বলে আসছেন। কিন্তু ইউরোপীয় নেতারা এবং জেলেনস্কি নিজে এই দায় সহজে মেনে নিতে পারবেন না। তারা তো এতদিন বলে এসেছেন—মাঠেই রাশিয়াকে হারানো সম্ভব।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে এক শান্তিচুক্তি হয়। তাতে যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল, ফ্রন্টলাইনও স্থির হয়েছিল। তখন সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে, আজ যা একরকম অসম্ভব—তাও সম্ভব ছিল। ইউক্রেন তখন ডনবাস অঞ্চলের ওপর সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে পারত, যদিও ক্রিমিয়া হারাতে হতো।

কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জেলেনস্কি শান্তির পথ ছেড়ে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করেন। রুশপন্থী নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার দাবি এবং নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস প্রকল্প বন্ধে চাপ—সবই পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলা সেই উত্তেজনারই ফসল।

এখন বাস্তবতা মেনে ইউক্রেন বলছে—পুরো রুশ বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার মতো দাবি তারা আর করছে না। বরং বর্তমান ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে প্রস্তুত। কিন্তু তার আগে তারা হারিয়েছে বহু এলাকা, অবকাঠামো, প্রায় ১৪,৫০০ বেসামরিক মানুষ এবং লাখের কাছাকাছি সেনা।

রাশিয়ার শর্তে শান্তিচুক্তি অমানবিক, হয়তো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থীও। কিন্তু বিকল্প কী? আরও ধ্বংস, আরও মৃত্যু, রাষ্ট্র হিসেবে আরও বিপর্যয়?

যারা এতদিন ইউক্রেনকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এখন তারাই যেন জেলেনস্কির চারপাশের দুর্নীতিকে অজুহাত বানিয়ে পিছু হটার পথ খুঁজছে।

লিওনিদ রাগোজিন রিগাভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।