Image description
 

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি উপলক্ষে চলতি মাসেই বিশাল সামরিক  কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে চীন। সেখানে যুদ্ধজাহাজ–বিধ্বংসী  হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে তারা। এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে একটি পরোক্ষ সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কোনো সংঘাত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বিমানবাহী রণতরী সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী হিসেবে শুধু চীনই নয়, রাশিয়াও এ ধরনের অস্ত্র তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। তারাও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে। 

তবে চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরিতে এখনো পিছিয়ে আছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটি এ ক্ষেত্রে উন্নতি করছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো টম কারাকো বলেন, ‘আমরা যখন সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিলাম, তখন চীন এ–জাতীয় প্রযুক্তি নিয়ে গুরুত্বসহকারে কাজ করেছে। তারা এ বিষয়ে এগিয়ে রয়েছে ঠিক। তবে আমরাও দ্রুত উন্নতি করছি।

হাইপারসনিক অস্ত্র শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারে। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলোর বিশেষ সামরিক সুবিধা রয়েছে। তবে এতে যে তাপ উৎপন্ন হয়, তা অনেক সময় নকশায় সমস্যার সৃষ্টি করে।

বিশ্বজুড়ে এখন হাইপারসনিক অস্ত্রের দুটি প্রধান ধরন নিয়ে গবেষণা চলছে। এর একটি হলো রকেটচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, আর অন্যটি হলো হাইপারসনিক গ্লাইড যান। এগুলো বায়ুমণ্ডলে উৎক্ষেপিত রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাইপারসনিক গতিতে চলে।

 

এ দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ও গতিপথ পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে এগুলোকে আটকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আদর্শ লক্ষ্যবস্তু হলো অত্যন্ত সুরক্ষিত স্থান বা এমন জায়গা, যেখানে আঘাত করতে সঠিক সময় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বিমানবাহী রণতরি বা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো যেতে পারে।

চীন ও রাশিয়া হাইপারসনিক অস্ত্রপ্রযুক্তিতে উন্নতি করছে বলে মনে করা হয়। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অতিরঞ্জিত দাবির কারণে তাদের প্রকৃত সামর্থ্য যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

৩ সেপ্টেম্বরের সামরিক কুচকাওয়াজে চীন বিভিন্ন ধরনের হাইপারসনিক অস্ত্র প্রদর্শন করেছে। এগুলোর মধ্যে ওয়াইজে-১৭, ওয়াইজে-১৯ এবং ওয়াইজে-২০ ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিতে বেইজিং এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।

এসব ক্ষেপণাস্ত্রের সব নকশা এখনো পরীক্ষা–নিরীক্ষার ধাপ অতিক্রম করেনি। বিভিন্ন সময় সামনে আসা তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে চীন তাদের সেনাবাহিনীতে ডিএফ-জেডএফ হাইপারসনিক গ্লাইড যান সরবরাহ শুরু করেছে।

এ নিয়ে চীনের গভীর মনোযোগের আরেকটি নিদর্শন হলো হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষায় তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ। ২০১৮ সালে তৎকালীন জ্যেষ্ঠ মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা মাইকেল গ্রিফিন এক সম্মেলনে বলেছিলেন, গত দশকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন ২০ গুণ বেশি হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছে।

রাশিয়ার এ–জাতীয় কর্মসূচির কেন্দ্রে রয়েছে অ্যাভানগার্ড (একটি গ্লাইড যান) এবং জিরকন (একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র)। এ ছাড়া রাশিয়া কিনজাল নামক একটি অস্ত্র মোতায়েন করেছে। এটি পুরোনো ও কম গতিশীল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি থেকে বানানো হয়েছে। তবে মস্কো একে হাইপারসনিক অস্ত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া জানিয়েছে, তিনটি অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এখন সেনাবাহিনীর জন্য এগুলোর উৎপাদন চলছে বলেও দাবি করেছে তারা।

তবে রাশিয়ার অতিরঞ্জিত দাবি বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র ‘অজেয়’ বলে দাবি করেছিলেন। তবে ইউক্রেন ২০২২ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৪০টি কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার দাবি করেছে। ইউক্রেন জিরকন ক্ষেপণাস্ত্রও ভূপাতিত করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে রাশিয়া অন্তত কিছু হাইপারসনিক অস্ত্র মোতায়েন করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হাইপারসনিক অস্ত্র মোতায়েন কর্মসূচি একাধিকবার বিলম্বিত হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা চলতি বছরের শেষ নাগাদ হাইপারসনিক অস্ত্র ‘ডার্ক ইগল’ মোতায়েনের পথে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাইপারসনিক কর্মসূচিও একইভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। এগুলো হলো এয়ার-লঞ্চড র্যাপিড রেসপন্স উইপন (এআরআরডব্লিউ) নামের একটি গ্লাইড যান ও হাইপারসনিক অ্যাটাক ক্রুজ মিসাইল (এইচএসিএম) নামের একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট নথি অনুযায়ী, উভয় কর্মসূচিতেই এসব ক্ষেপণাস্ত্রের গঠনে সমস্যা দেখা গেছে। তবে ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী এআরআরডব্লিউ উৎপাদন শুরুর চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাবদিহি কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৭ সালে এইচএসিএম উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো টড হ্যারিসন বলেন, হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি ধীর মনে হলেও বাস্তবে তাদের অবস্থা ততটা খারাপ নয়।

টড হ্যারিসন আরও বলেন, প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করতে হবে, চীনের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু নেই। উদাহরণস্বরূপ, চীনের বিমানবাহী রণতরি বহরে মাত্র তিনটি জাহাজ রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর কাছে রয়েছে ১১টি জাহাজ। এ ছাড়া শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অতিক্রম করতে যুক্তরাষ্ট্রের আরও উপায় রয়েছে। যেমন স্টেলথ বিমানের বহর। এটি চীনের সামর্থ্যকেও ছাড়িয়ে যায়।

ওয়াশিংটন কত দ্রুত এই ব্যবধান কমাতে পারে, সে প্রশ্ন তুলছেন সবাই। সিএসআইএসের বিশেষজ্ঞ টম কারাকো বলেন, তিনি এখনো অর্থ বরাদ্দে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ দেখতে পাননি।

সাম্প্রতিক পুনর্বাসন বিল ও সর্বশেষ বাজেটে কিছু মামুলি ইতিবাচক সংকেত দেখা গেলেও এখনো বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে টম কারাকো উল্লেখ করেন।

সূত্র: ফরেন পলিসি