Image description
 

ইরানের রাজধানী তেহরানের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘এবরাত জাদুঘর’—একসময় ছিল ইরানের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার। এই কারাগারটি শুধু নির্মম নির্যাতনের জন্যই কুখ্যাত নয়, বরং এটি ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে। কারণ এখানে বন্দি ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।

১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। বর্তমানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ‘ফতোয়া’ জারি করে তাদের ‘আল্লাহর শত্রু’ ঘোষণা করেন খামেনি। এই ফতোয়ার পেছনে ছিল চলতি বছরের ১৩ জুন শুরু হওয়া ১২ দিনের এক যুদ্ধে ইসরায়েলের ইরানে বিমান হামলা, যাতে নিহত হন দেশটির কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী।

তবে এই শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হতে খামেনিকে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন এক জীবনযাত্রা। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে ইসলামি বিপ্লবের আগে তিনি যে কারাগারে আট মাস বন্দি ছিলেন, সেটিই আজকের ‘এবরাত জাদুঘর’।

কারাবন্দি খামেনি: একটি সংগ্রামের ইতিহাস

১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ইসলামি বিপ্লবের পক্ষে সক্রিয় আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে বারবার গ্রেপ্তার হন খামেনি। সে সময় শাহের গোপন পুলিশ ‘সাভাক’ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করত। তেহরানের এই কারাগারটি সে সময় ‘জয়েন্ট কমিটি এগেইনস্ট সাবোটাজ’ নামে পরিচিত ছিল। এখানেই ছয়বার বন্দি করা হয় খামেনিকে।

আজ সেই কারাগারটি একটি জাদুঘর—প্রদর্শনীর এক কোণে টাঙানো রয়েছে খামেনির একটি ছবি, নিচে লেখা—‘আয়াতুল্লাহ সৈয়দ আলী খামেনি’। পাশে একটি মোমের মূর্তি, যেখানে খামেনিকে দেখানো হয়েছে কালো পাগড়ি, গোল চশমা ও বাদামি চাঁদর পরা অবস্থায়—ঠিক যেভাবে তিনি বন্দি জীবন কাটিয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের বিবরণ

১৯৬২ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে কওম শহরে আন্দোলনে যুক্ত হন খামেনি। তিনি খোমেনির বার্তা মাশহাদের আলেমদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ১৯৬৩ সালে বীরজান্দে প্রথমবার গ্রেপ্তার হন তিনি।

১৯৭২-৭৫ সালে মাশহাদের তিনটি মসজিদে তিনি কুরআন ও ইসলামী আদর্শ নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। ‘নাহজুল বালাগা’ বিষয়ক তাঁর বক্তৃতা বিপুল সংখ্যক তরুণকে আকৃষ্ট করে। এতে ভয় পেয়ে সাভাক ১৯৭৫ সালের শীতে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে, গ্রেপ্তার করে এবং বহু মাস তেহরানের কুখ্যাত ‘পুলিশ-সাভাক যৌথ কারাগারে’ (বর্তমান এবরাত জাদুঘর) আটকে রাখে। তিনি বলেন, এই বন্দি জীবন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়।

খামেনির বিপ্লবী উত্থান

ইমাম খোমেনির শিষ্য হিসেবে ৬০-এর দশক থেকে খামেনি ছিলেন ইসলামি আন্দোলনের অগ্রভাগে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর শাহ পলায়ন করলে এবং খোমেনি প্যারিস থেকে ফিরে এলে, রাজনৈতিকভাবে খামেনির পরিচয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন, তেহরানের জুমার খতিব নিযুক্ত হন এবং ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার পদে আসীন হন।

নারীদের জন্য ‘হিজাব’ ছিল অপরাধ!

এই কারাগারে শুধু খামেনিই ছিলেন না—বন্দি ছিলেন হাজারো ইসলামি চিন্তাবিদ ও নারীরা, যারা হিজাব পরতে চাইতেন। শাহের যুগে নারীদের মাথা ঢেকে রাখাও ছিল অপরাধ। সেইসব নারীদের ছবি এখনো সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরে।

এবরাত জাদুঘর: ইতিহাসের নিষ্ঠুর দলিল

১৯৩২ সালে রেজা শাহ পাহলভির নির্দেশে জার্মান প্রকৌশলীদের নির্মিত এই ভবনটি ইরানের প্রথম আধুনিক কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে এটি নারীদের জন্যও কারাগারে পরিণত হয়। মূলত ৬০-৭০ এর দশকে এটি হয়ে ওঠে ইসলামী বিপ্লবের কর্মীদের দমন ও নির্যাতনের ঘাঁটি। পরে ২০০০ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত শেষে কারাগারটি বন্ধ করা হয় এবং ২০০২ সালে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে।

স্থাপত্য ও নিদর্শন

চারতলা ভবনটি ভূমিকম্প-নিরোধক এবং কেন্দ্রীয় গোলাকৃতি একটি উঠান ঘিরে পরিকল্পিত। এখানকার দেয়াল নির্মিত হয়েছে এমনভাবে, যেন বন্দিদের চিৎকার বাইরে পৌঁছাতে না পারে। জাদুঘরে রয়েছে একক সেল, নির্যাতন কক্ষ, সাক্ষাৎ কক্ষ ও বন্দিদের পোশাকঘর।

প্রদর্শনীতে রয়েছে:

  • মোমের পুতুল ও নির্যাতনের দৃশ্য (প্রতীকী)
  • প্রামাণ্যচিত্র ও সাক্ষাৎকার
  • সাবেক বন্দিদের গাইড ট্যুর
  • ছবি ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র

জাদুঘরের তাৎপর্য ও ভ্রমণ তথ্য

‘এবরাত জাদুঘর’ শুধু একটি ইতিহাস নয়, বরং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক বাস্তব স্মারক। এটি মানবাধিকার সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জাদুঘরটি তেহরানের ইমাম খোমেনি স্কয়ারে অবস্থিত। এটি প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত, রয়েছে ইংরেজি গাইডেড ট্যুর ও সাবেক বন্দিদের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বর্ণনা। প্রবেশের জন্য টিকিট প্রয়োজন এবং আবেগপ্রবণ দর্শকদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।