
২৬ এপ্রিল। পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার চার দিন পর লিয়াকত আলি শেখ (৫১) আহমেদাবাদের চন্দোলা তালাও বস্তিতে নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। তখন রাত ৪টা। হঠাৎ করেই একদল পুলিশ তার দরজায় কড়া নাড়ে। লিয়াকত ও তার পরিবারের আরও পাঁচ সদস্যকে ঘরের বাইরে আসতে বলা হয়। এরপর চার ঘণ্টা ধরে কাছাকাছি একটি ফুটবল মাঠে তাদের বসিয়ে রাখা হয়। ওই এলাকায় শত শত বাসিন্দাকে একইভাবে কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ শনাক্ত করে অভিযানে নামে পুলিশ। সকাল ৮টার দিকে নারীদের ছেড়ে দেয়া হয়। পুরুষদের রাস্তায় হাঁটিয়ে ৩ কিলোমিটার দূরের একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটাই শেষবার লিয়াকতের ভাবি যখন হামিদা বানু তাকে দেখেছেন। ৫১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকি জেলার বাসিন্দা। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ। পরিবার আশঙ্কা করছে, তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ মেলেনি। এ খবর দিয়েছে ভারতের অনলাইন স্ক্রল।
এ নিয়ে দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। তাতে আরও বলা হয়, আহমেদাবাদে আটক ৭৮ জন অনিবন্ধিত কথিত বাংলাদেশি অভিবাসীকে একটি সামরিক বিমানে করে ভারতের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদেরকে পানিপথে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার এক পুলিশি রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
লিয়াকত আলির বড়ভাই মুজাফফর আলি শেখ বলেন, সে মানসিকভাবে অসুস্থ। নিজের মধ্যেই গুটিয়ে থাকে সে। আমরা আশঙ্কা করছি, সে হয়তো পুলিশের কাছে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। ৫ই মে মুজাফফর গুজরাট হাইকোর্টে একটি হ্যাবিয়াস কর্পাস (নিখোঁজ ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ) মামলা করেন। কিন্তু ২৪শে জুন আদালত তা খারিজ করে দেয়। আদালত বলেছে, পুলিশের জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী, তারা কখনো লিয়াকতকে আটক বা গ্রেফতার করেনি। কিন্তু পরিবার টিভি-৯ গুজরাটি চ্যানেলের একটি ভিডিও জমা দেয়, যেখানে ২৬শে এপ্রিল লিয়াকত আলিকে মাটিতে বসে থাকতে দেখা গেছে অন্য আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে। স্ক্রল এমন দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে, যারা লিয়াকতকে শেষবার থানায় দেখেছেন।
পুলিশ একটি সিসিটিভি ভিডিও আদালতে পেশ করে, যেখানে ১লা মে গায়কোয়াদ হাভেলির অপরাধ শাখা অফিস থেকে একজনকে বের হতে দেখা যায়। তারা দাবি করে, ওই ব্যক্তি লিয়াকতই। আদালত সেই ভিডিওর ভিত্তিতে মামলা খারিজ করে দেয়। তবে মুজাফফর আলি শেখের আইনজীবী আওম কোটওয়াল আদালতে বলেন, এই ভিডিও পরিবারকে সরবরাহ করা হয়নি। শুধু আদালতে তাকে দেখানো হয়েছে। মুজাফফর আলি শেখ বলেন, আমরা জানি না সে এখনো আটক আছে, বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, নাকি আহমেদাবাদের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, যদি সে থানায় থেকে ছাড়া পেয়ে থাকে, তাহলে সে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে যেত। এখন পরিবার সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আহমেদাবাদ পুলিশের কমিশনার জি.এস. মালিক বলেন, এই মামলা সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না। পেহেলগাম হামলার পর অপারেশন সিঁদুর-এ দেশজুড়ে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু হয়।
মুম্বইয়ের মীরা রোডে এমনই এক অভিযানে পশ্চিমবঙ্গের সাতজন বাঙালি মুসলিমকে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে থেকে বের করে দেয়া হয়। পরে তাদের আবার ফিরিয়ে আনা হয়। বহুজনকে সরাসরি ‘পুশ ব্যাক’ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষেত্রে তো আন্তর্জাতিক জলসীমায় ফেলে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
লিয়াকত আলি বারাবাঁকি জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা। ২০ বছর আগে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে আহমেদাবাদে যান। প্রথমে তিনি জয় ভারত টেক্সটাইল মিলে চাকরি নেন। কিন্তু মানসিক সমস্যার কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। তিনি বেকার ছিলেন এবং খুব কমই কথা বলতেন। তার ভাই মুজাফফর বলেন, সে নিজে নিজে বিড়বিড় করত। তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর মানসিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরিবার তাকে নানা দরগায় নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসাগতভাবে তার মানসিক সমস্যার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২৬শে এপ্রিল যখন পুলিশ আসে, তখন লিয়াকত আলি শেখ ছিলেন বারাবাঁকিতে। তার স্ত্রী, পুত্রবধূ ও নাতনিকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলেও ৪ ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়। মুজাফফর আরও বলেন, তাদের পরিচয়পত্র জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু পুরুষদের- আমার দুই ছেলে ও লিয়াকতকে আটক করে রাখা হয়। ভাগ্নে আকবর আলির মতে, প্রথমে তাদের খোলা মাঠে বসিয়ে রাখা হয় সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। তারপর আমাদের ৩ কিলোমিটার হেঁটে বহরামপুরা থানায় যেতে বলা হয়। আমাদের কোনো খাবার বা পানি দেয়নি এ সময়ে।
আহমেদাবাদের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী উজ্জাইনি বলেন, পুলিশের এই ধরপাকড় অবৈধ। শিশুসহ সবাইকে জনসমক্ষে হাঁটিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এরপর তাদের অপরাধ শাখার গায়কোয়াদ হাভেলি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। আকবর বলেন, আমরা সেখানেই বসেছিলাম দুপুর ২টা পর্যন্ত। তারপর আমাদের দলভিত্তিক বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়। আমি ও আমার ভাইকে জুহাপুরা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আমার চাচাকে অপরাধ শাখায় একা বসে থাকতে দেখি। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি।
পরিবারের সদস্যদের আটকের পর ২৮শে এপ্রিল বস্তি থেকে মালপত্র সরাতে বলে সিটি কর্পোরেশন। পরদিন সকালে চন্দোলা তালাও বস্তির শত শত ঘরের সঙ্গে লিয়াকত আলি শেখদের ঘরও ভেঙে ফেলা হয়। কর্পোরেশন বলে, তারা বাংলাদেশি সন্দেহে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করছে। আকবর আলি শেখ বলেন, আমরা তখন চাচাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর আমাদের ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছিল। পরিবার তখন এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠে। উজ্জাইনি বলেন, শেখ পরিবারসহ অনেক পরিবারকে কোনোরকম নোটিশ ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়েছে।
১লা মে বারাবাঁকি থেকে ফিরে মুজাফফর আলি শেখ জমির দলিল, রেশন কার্ড নিয়ে গায়কোয়াদ হাভেলি যান। পুলিশ তাদের জুহাপুরা যেতে বলে। জুহাপুরা থেকে সাহিবাগ। এভাবে ছয়টি থানায় ঘুরেও লিয়াকতের খোঁজ মেলেনি। এক সপ্তাহ পর তারা হাইকোর্টে হ্যাবিয়াস কর্পাস মামলা করেন। ১০ই জুন আদালতে সরকারি কৌঁসুলি একটি ভিডিও দেখান, যেখানে বলা হয় ১লা মে লিয়াকত ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু পরিবার তা দেখতে পায়নি। মুজাফফর আলি শেখ বলেন, আমরা জানি না সে কোথায় আছে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়। তাই তাকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনা পুলিশের দায়িত্ব। তিনি বলেন, লিয়াকত ছাড়া পেয়ে থাকলে, সে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসতো। যাদের বাড়ি ভাঙেনি, তারা অন্তত তাকে বলে দিতে পারত আমরা কোথায় গিয়েছি। আমরা সবাই একে-অপরকে চিনি। কিন্তু সে কখনোই চন্দোলায় ফিরে আসেনি।
এখন এই পরিবারের একমাত্র আশা- ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।