সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছালমা খাতুন দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। কিন্তু তার নামে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করেন কলেজের অধ্যক্ষ সাহেদ আলী। শুধু তাই নয়; ছালমা খাতুনের উপস্থিতি দেখাতে কলেজের হাজিরা খাতায়ও জাল স্বাক্ষর করা হয়েছে। নিয়মিত বেতন উত্তোলনের জন্য ছুটির আবেদন এবং প্রশাসনিক নথিও জাল করেছেন অধ্যক্ষ। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবদুল লতিফ সরকার, হিসাব রক্ষক সাইফুল ইসলাম এবং অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম।
সম্প্রতি ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগের তদন্ত করে তিন সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির প্রধান ছিলেন সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. শরীফ-উস-সাঈদ। একই কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াৎ হোসেন, সহকারী অধ্যাপক ড. মো. ইসমাইল হোসেন কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন। সম্প্রতি কমিটি তাদের প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) জমা দিয়েছে। জমা হওয়া প্রতিবেদন এবং কলেজ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ছালমা খাতুন ২০২০ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। কিন্তু কলেজের অভ্যন্তরীণ নথিপত্রে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একাধিক সময়ে তার ‘যোগদান’, ‘ছুটির মেয়াদ শেষ’, ‘কাজে ফিরে আসা’ ইত্যাদি উল্লেখ করে আবেদনপত্র রাখা হয়েছে। হাজিরা খাতায়ও কয়েক মাসে উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। সবকিছুই করা হয়েছে জাল নথিপত্রর মাধ্যমে। বিদেশে থাকলেও ২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে হাজিরা খাতায় ছালমা খাতুনের কোনো স্বাক্ষর নেই; অথচ বেতন তোলার জন্য ওই দুই মাসেও তাঁকে ‘উপস্থিত’ দেখানো হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর ছালমা খাতুনের নামে যে যোগদানের আবেদন করা হয়েছে, সেটি তার স্বাক্ষর নয়। আবেদনের আকার-গঠন ও লেখার ধরণ তুলনা করে দেখা গেছে, আবেদনটি অন্য কারও হাতে লেখা। একইভাবে ২০২৪ সালের পহেলা ডিসেম্বর তারিখে ছালমা খাতুনের যোগদানের কাগজেও একই অসঙ্গতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নথি তৈরি করা হয়েছে মূলত তার বেতন চালু রাখতে এবং শিক্ষিকার অনুপস্থিতি আড়াল করতে।
ছালমা খাতুন ২০২০ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। কিন্তু কলেজের অভ্যন্তরীণ নথিপত্রে ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একাধিক সময়ে তার ‘যোগদান’, ‘ছুটির মেয়াদ শেষ’, ‘কাজে ফিরে আসা’ ইত্যাদি উল্লেখ করে আবেদনপত্র রাখা হয়েছে। হাজিরা খাতায়ও কয়েক মাসে উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। সবকিছুই করা হয়েছে জাল নথিপত্রর মাধ্যমে। বিদেশে থাকলেও ২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে হাজিরা খাতায় ছালমা খাতুনের কোনো স্বাক্ষর নেই; অথচ বেতন তোলার জন্য ওই দুই মাসেও তাঁকে ‘উপস্থিত’ দেখানো হয়েছে।
অধ্যাপক ছালমা খাতুনের অর্জিত ছুটির ক্ষেত্রেও তদন্তকারীরা গুরুতর বিধি লঙ্ঘনের পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালের শিক্ষা ছুটি বিধিতে টানা এত দীর্ঘ সময় অর্জিত ছুটি ভোগের সুযোগ নেই। কিন্তু কলেজের নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৯ মাস এবং ২০২৫ সালে ৬ মাস—মোট ১৫ মাস ছুটি অনুমোদন করেছেন অধ্যক্ষ সাহেদ আলী ও তাঁর পছন্দ অনুযায়ী গঠিত পরিচালনা পর্ষদ। তদন্ত কমিটি বলছে—এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি সম্পর্কে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে ‘এমপিও স্থগিতের সুপারিশ’ পাঠানোর নিয়ম থাকলেও অধ্যক্ষ তা করেননি।
শুধু ছুটি নয়; আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ছালমা খাতুনের চার বছরের ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে দেখা গেছে, বেতন অ্যাকাউন্টে টাকা জমার পর নিয়মিত চেকের মাধ্যমে তা উত্তোলন করা হয়েছে। এই সময়ে ছালমা খাতুন দেশের বাইরে অবস্থান করলেও চার লাখ টাকার বেশি চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ সাহেদ আলী, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবদুল লতিফ সরকার, হিসাব রক্ষক সাইফুল ইসলাম এবং অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম বেতন বিল জমা দেওয়া এবং টাকা উত্তোলনের সাথে জড়িত বলে জানিয়েছেন কলেজ সংশ্লিষ্টরা।
অধ্যক্ষ সাহেদ আলী তদন্ত কাজে সহযোগিতা করেননি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তকারীদের অনুরোধ সত্ত্বেও ছালমা খাতুনের পাসপোর্টের অনুলিপি তিনি সরবরাহ করেননি। ছুটি অনুমোদন, হাজিরা সার্টিফিকেশন, এমপিও সংক্রান্ত নথি প্রেরণ—এসব ক্ষেত্রেই অধ্যক্ষের ভূমিকা ‘অস্বচ্ছ এবং উদ্দেশ্যমূলক’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব অনিয়মের ঘটনায় সহযোগী অধ্যাপক ছালমা খাতুনের স্থগিত করা, ছুটির আবেদন, যোগদানের কাগজ ও হাজিরা খাতা জাল করে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে অধ্যক্ষ সাহেদ আলী এবং পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আবদুল লতিফ সরকারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া; সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও চেক উত্তোলনের ব্যাপারে বিশেষ আর্থিক তদন্ত এবং কলেজের সম্পূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামো—হাজিরা খাতা, ছুটি রেজিস্টার, এমপিও বিল—এসব বিষয়ে পুনঃতদন্ত চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাহেদ আলীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা বিচারাধীন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত মো. শিহাবের বাবা শামীম ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানায় একটি মামলা করেন। এছাড়া ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলেজে তদন্ত কমিটি তদন্ত করতে আসলে কর্মকর্তার সামনেই একজন অভিভাবকের ওপর হামলা করেন সাহেদ আলী। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের হয়।
এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এরপর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন। পলাতক থাকলেও পরিচালনা পরিষদের সহযোগিতায় মাঝে মাঝে কলেজে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন তিনি।
অধ্যক্ষ সাহেদ আলীর এসব অনিয়ম কলেজের অনেকেই জানতেন। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে কলেজে থাকা তার অনুসারীরা অভিযোগকারীদের মারধর এবং ভয়ভীতি দেখান। এর ফলে কলেজের কেউ কখনো সামনে এসে অভিযোগ করার সাহস দেখাতে পারেননি।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কলেজের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ছালমা খাতুনের স্বাক্ষর জাল করে কলেজে উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন অধ্যক্ষ সাহেদ। তার অনুসারীদের দিয়ে চেকের মাধ্যমে সেই টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন তিনি। এসব ঘটনায় কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে মারধরসহ কলেজ থেকে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিতেন। এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন কলেজের পরিচালনা পরিষদ (ম্যানেজিং কমিটি)। ম্যানেজিং কমিটিতে সবাই অধ্যক্ষের অনুসরাী। যার ফলে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখায়নি।’
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষ আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিতেন, আমি সেভাবেই কাজ করতাম। এসব অনিয়মের সাথে অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম জড়িত। আমি কেবল অধ্যক্ষের নির্দেশ পালন করতাম।’
যদিও অফিস সহকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো বেতন বিলে স্বাক্ষর করিনি। আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে। ব্যাংক থেকে একজনের টাকা আরেকজন কীভাবে তুলবে? এটি সম্ভব না।’ তাহলে তদন্ত কমিটি ৪ লাখের বেশি টাকা উত্তোলন করল কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্তের পুনঃতদন্ত হয়, সাংবাদিক হিসেবে এটা তো আপনি জানেন?’ এ সময় সাইফুল ইসলাম বিষয়গুলো নিয়ে এ প্রতিবেদককে সাক্ষাতে কথা বলার অনুরোধ জানান।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যক্ষ সাহেদ আলীর মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে আজও পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন তিনি। অন্যদিকে কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আব্দুল লতিফ সরকারের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি বার বার কল কেটে দেন। পরে মোবাইল ফোনে বক্তব্য জানতে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। এক পর্যায়ে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
ফুলেজোড় ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. নওসের আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। তবে এ মুহূর্তে ফাইল আমার কাছে নেই। আপনি অফিসে এসে প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।’
বিধি লঙ্ঘন করে ডিগ্রি কলেজে সভাপতি পদে আব্দুল লতিফ সরকার
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে মনোনীত হতে হলে অবশ্যই স্নাতকোত্তর পাস হতে হয়। তবে এই বিধি উপেক্ষা করে ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আব্দুল লতিফ সরকার। জানা গেছে, আব্দুল লতিফ সরকার ডিগ্রি পাস। স্নাতকোত্তর পাস না হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর ব্যাকডেট দেখিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করিয়ে নেন।
বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নজরে আসার পর লতিফ সরকারের সভাপতির দায়িত্ব বাতিল করে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) সভাপতি করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরে লতিফ সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন এবং আদালত ডিসিকে সভাপতি নিয়োগের কার্যকারিতা স্থগিত করেন।
এ ঘটনার পর তদন্তে উঠে আসে আরও গুরুতর অভিযোগ। সভাপতি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন কলেজ সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, আব্দুল লতিফ সরকার বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও গত ১৬ বছর ধরে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় করে কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য, দোকানঘর ভাড়া থেকে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত ছিলেন। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই যেকোনো মূল্যে কলেজ কমিটি ছাড়তে নারাজ তিনি।