ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) উদ্যোগে ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৫ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এ আয়োজনে ডাকসুর পক্ষ থেকে বিগত দুই মাসের কার্যক্রম উপস্থাপন করা হয়। এ সময় ডাকসু ও হল সংসদের অর্জন ও বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন তারা। সমস্যার কথা জানিয়ে সমাধানও চেয়েছেন।
সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল সংসদের সহ-সভাপতিবৃন্দ (ভিপি) তাদের হলের সার্বিক কার্যক্রম, অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। হল সংসদগুলোতে সম্পন্ন হওয়া কাজের মধ্যে রয়েছে: ক্যান্টিন মনিটরিং, খাবারের মানোন্নয়ন, নতুন ক্যান্টিন ও পানির ফিল্টার স্থাপন, খেলার মাঠ সংস্কার, ইনডোর–আউটডোর খেলাধুলার সরঞ্জাম বৃদ্ধি এবং কয়েকটি হলে জিমনেশিয়াম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ উন্নত করতে রিডিং রুম সংস্কার, নতুন ওয়াইফাই সংযোগ স্থাপন ও পর্যাপ্ত চার্জিং পোর্ট যুক্ত করা হয়। কয়েকটি হলে প্রশাসন বা স্পন্সরের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ফ্যান, ফ্রিজ, ও ইলেকট্রিক পাম্প প্রভৃতি স্থাপন করা হয়েছে। সিঙ্গেল সিট বরাদ্দ বাড়ানোসহ আবাসন সংকট কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিনিধিরা যে প্রধান সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাজেট ঘাটতি, প্রশাসনের অসহযোগিতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। বহু হলে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি শিক্ষার্থী থাকায় আবাসন সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে এবং খাদ্যের গুনগতমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনো হয়নি।
পুরোনো ভবনের পলেস্তারা খসে পড়া, গ্যাস সংকট, জরুরি গেট ব্যবহারে জটিলতা, নিরাপত্তাহীনতা, বহিরাগতদের উপদ্রব, সিসিটিভি সংকট এবং খেলার মাঠ, সাইকেল স্ট্যান্ড, জিমনেসিয়াম, ফার্মেসি, ইনডোর গেমস সরঞ্জাম, গার্ড–ক্লিনার–অফিস সহকারী স্বল্পতার বিষয়গুলোও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। প্রতিনিধিরা এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।
ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন, সাদা দলের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিন, ইউটিএলের আহবায়ক অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান বিশ্বাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন অনুষদের ডিনরা।
দুই মাসের কার্যক্রম স্লাইড প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম ফরহাদ। সম্মেলনের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করেন ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য তাজিনুর রহমান। এরপর গীতা পাঠ করেন জগন্নাথ হল সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক রাতুল দে দীপ্ত এবং ত্রিপিটক পাঠ করেন ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্য সর্বমিত্র চাকমা। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
জাতীয় সংগীতের পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত সকল শহীদ ও আহতদের স্মরণে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন ডাকসুর আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক সাখাওয়াত জাকারিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে ও ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদের সঞ্চালনায় প্রতিনিধি সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ও ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এইচ এম মোশারফ হুসেন ও ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) সাদিক কায়েম।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ডাকসুর ব্যাপারে সারা বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল, সবার গভীর আগ্রহ আছে। সিনেটে আজকে একটি পার্লামেন্ট ভাব মনে হচ্ছে। এই ডাকসু আয়োজন করার কৃতিত্ব পুরো নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। আজকের সম্মেলনে অনেকগুলো সমস্যার কথা এসেছে এগুলো, এগুলোতে আমরাও একমত।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক অনেক অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু আমাদেরকে সমস্যা সমাধানের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করলে শতভাগ না হোক কিছু কাজ হলেও করা সম্ভব। সীমাবদ্ধতার পরেও ডাকসুর পরবর্তী দুই মাসে অনেকগুলো কাজ হয়েছে। তোমরা করে দেখিয়েছো, এটার ধারাবাহিকতা আমাদেরকে রাখতে হবে।
ভিপি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন গণরুম-গেস্টরুম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির রাজনীতি নেই। বরং এখন শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্যাম্পাসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নেতা নয় বরং প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব। আমরা আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া প্রত্যেকটি সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে পলিটিক্যালি কনশাস এবং একাডেমিক ইনস্টিটিউট। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ জ্ঞান উৎপাদন, গবেষণার পরিবেশ তৈরি এবং গবেষণায় বাজেট বাড়ানোর মাধ্যমে এটিকে পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক ইনস্টিটিউট হিসেবে রূপান্তর করতে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, খুনি হাসিনা এবং তার দোসররা গত ১৬ বছরে শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের বৈধতা দিয়েছে। খুনি হাসিনার ফাঁসির রায় আসার পরে ‘প্রগতিশীল শিক্ষক’ নামে কিছু ব্যক্তি বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে। যারা খুনি হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সে যেই হোক, তার স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে এবং তাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ডাকসুর প্রেজেন্টেশনে দেখানো কার্যক্রমের চেয়েও বাস্তবে অনেক বেশি কাজ হয়েছে, যদিও অনেক ছোট ছোট কার্যক্রম উঠে আসেনি। গত দুই মাসে যে অগ্রগতি দেখা গেছে, তা ধারাবাহিকভাবে চালু থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। আমাদের পরিকল্পিত মানসিক স্বাস্থ্য ও ক্যারিয়ার গাইডলাইন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজগুলো ডাকসু বাস্তবায়ন করছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে সমর্থন দিয়ে সেই প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করছো তোমরা। ব্যুরোক্র্যাটিক অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আলোচনা ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হচ্ছে। কিছু কাজ সময়সাপেক্ষ হলেও, সকলের সদিচ্ছা ও ভালো কিছু করার ইচ্ছার কারণে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন সম্ভব।’
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ডাকসুর বিগত দুইমাসের কাজের উপস্থাপনা দেখে বিস্মিত হয়েছি। দুই মাসের মধ্যে এত চমৎকার কাজ শুরু করা যেতে পারে এটা অবিশ্বাস্য। এই কাজগুলোর অনেকগুলোই সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ ছিল। শিক্ষার্থী এবং প্রশাসন ও সবার সম্মিলিত উদ্যোগে অসাধারণ কাজ করা সম্ভব, ডাকসু দুই মাসের মধ্যে তারই প্রমাণ দেখিয়েছে। সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সম্মিলিতভাবে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে এবং ঘাটতি বাজেট দিয়েই চলতে হয়। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে হবে এবং টাকা জোগাড় করতে হবে। টাকা যেন সমস্যা না হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের প্রত্যেকে যদি তার নির্ধারিত অবস্থান থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তা পূরণ হবেই।