Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর ডাকসু নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে বড় আলোচনাটা হলো, ছাত্রদলকে কেন ভোট দিল না বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। ফল সবাই জানি: শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ২৮টির মধ্যে ২৩টি পদ জিতেছে, আর শীর্ষ তিনটিতেই (ভিপি, জিএস, এজিএস) তাদের প্রার্থীরা বিশাল ব্যবধানে জয়ী। শুধু সংখ্যাটাই নয়, ব্যবধানটাও চোখে পড়ার মতোভিপি পদে আবু সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১৪,০৪২ ভোট; জিএস পদে এস. এম. ফরহাদ ১০,৭৯৪ ভোটঅন্যরা বহু পেছনে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে ভোটাররা দলে দলে একই দিকে গিয়েছেন। নির্বাচনের আয়োজনটাও ছিল একটু আলাদা। হলের ভেতর নয়, আটটি আলাদা কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে ভোট, ব্যালটে ভোট দিয়ে ওএমআর শিটে গণনা। মোট ভোটার প্রায় ৪০ হাজার। সারাদিন লম্বা লাইন, বিশেষ করে সকাল থেকে দুপুর, অনেকেই এটাকে দীর্ঘদিন পর আরাম করে ভোট দেওয়ার সুযোগ বলেছেন। এই উচ্চ অংশগ্রহণ শিবির প্যানেলের পক্ষে গিয়েছে, কারণ তারা আগেই নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক টার্গেট করে মাঠে কাজ করেছে।  

এখন আসি মূল আলোচনায়; ছাত্রদলকে কেন শিক্ষার্থীরা ভোট দিল না? মূল কারণটি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আগস্টের পর দেশে বিএনপি তার সহযোগী সংগঠনগুলোর কিছু অংশের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় দখল, চাঁদা তোলা, ভাঙচুর সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। পুরোনো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিবালোকে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে, পাথর মেরে হত্যার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়; অভিযোগ ওঠে এতে যুবদল ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জড়িত। পরে গ্রেপ্তার, রিমান্ড এমনকি সংশ্লিষ্ট দুএকজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়। ঘটনাটি শিক্ষার্থীদের মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে নিরাপত্তা চাঁদাবাজি ভীতির প্রসঙ্গে। ক্যাম্পাস ভোটে এই ধরনের দূরের ঘটনাও মনোভাব বদলে দেয়, কারণ সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে সবকিছু ছড়িয়ে পরে মুহুর্তেই। বিএনপি বলছে, শৃঙ্খলা ভাঙলে জিরো টলারেন্স নীতি; তার প্রেক্ষিতে গত কয়েক মাসে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, বহিষ্কারও আছে। কিন্তু বাইরে থেকে ছবিটা দাঁড়িয়েছে উল্টো, প্রশ্ন জাগছে সবার মনেই, এত বহিষ্কার লাগছে কেন? তবে কি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে নেতৃত্ব? ঢাবির ভোটারের বড় অংশ এই প্রশ্নটাই করেছে মনেমনে। ওরা এই দেশের সবচেয়ে স্মার্ট মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা দেখেছে বহিষ্কারের খবর আছে, কিন্তু অপরাধ প্রতিরোধে সংগঠন আগেভাগে কেমন কাজ করছে তার স্পষ্ট, ধারাবাহিক প্রমাণ খুব কম। যার ফল ঢাবি ইউনিট ছাত্রদল যতই পরিষ্কার রাজনীতি করুক, জাতীয় ইমেজের বোঝা তাদের কাঁধেই গিয়ে পড়েছে।

এরপরে যে কারনটি আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন তা হলো সংগঠন পরিচালনা আর মাঠের কাজের পার্থক্য। শিবির সমর্থিত জোট আগস্টের পত থেকেই হলে হলে নেটওয়ার্ক বানিয়েছে। কে কোন হলে থাকে, কার কী সমস্যা, কার কখন বাস লাগে; এই সূক্ষ্ম তথ্যগুলো তারা আগে থেকেই হাতে রেখেছে। নারী শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে তারা আলাদা ক্যাম্পেইন করেছে: নিরাপত্তা, আলো-অন্ধকার পথ, রাতে বাস শিডিউল, হলের খাবারের মান সব নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সার্ভে বিশ্লেষণ রিপোর্টগুলো বলছে, নারী হলগুলোয় শিবির প্যানেল প্রায় একচেটিয়া ভোট পেয়েছে; এটিই শীর্ষ তিন পদে তাদের বিশাল ব্যবধানের বড় কারণ। ছাত্রদল এই জায়গাটায় ধারাবাহিক, ব্যবহারিক মেসেজ দিতে পারেনি।

ছাত্রদল আরএকটি বড় ধাক্কা খায় তাদের প্রচার প্রচারণার ধরনে। শিক্ষার্থীর মাথায় সবচেয়ে আগে থাকে দৈনন্দিন ঝামেলা: হলের সিট, খাবারের মান, লাইব্রেরির সময়, রাতে যাতায়াত, হয়রানি থেকে নিরাপত্তা। শিবির প্যানেলের ইশতেহারটা এই দৈনন্দিন কথাগুলো দিয়েই শুরু, এক বছরের মধ্যে কী কী করবে, সময়ে সময়ে কীভাবে রিপোর্ট দেবে ধরনের সোজাসাপ্টা প্রতিশ্রুতি। ফলে ভোটারদের কাছে তারা রাজনৈতিক সংগঠন এর চেয়ে সমস্যা সমাধানের দল হিসেবে দেখা গেছে। ছাত্রদলের বার্তায় এই ব্যবহারিক অংশটা যথেষ্ট জোরে ওঠেনি। সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা তারা দেখাতে পারেনি যা সাধারন শিক্ষার্থীদের মনে দাগ কাটবে। এর পেছনের কারনটা হলো তাদের সমন্বয়ের ঘাটতি।  ডাকসুতে এবার একাধিক জোট অনেক স্বাধীন প্রার্থী লড়েছে। বামেরা আলাদা, জুলাই কেন্দ্র করে কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম আলাদা, আবার স্বতন্ত্ররাও নিজের নিজের প্রচার করেছে। এই বিভক্তি শিবির প্যানেলের জন্য লাভজনক হয়েছে। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোট ভাগ হয়েছে। ছাত্রদলও শেষ পর্যন্ত বড় কোনো একক ছাতার নিচে বাকিদের নিয়ে আসতে পারেনি। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন ঘিরে দেখা গেল ছাত্রদল অভ্যন্তরীণ জায়গাতেই প্যানেল দিতে দেরি করছে, ঝামেলা কাটাতে আয়োজকরা ব্যস্ত; এই সংকেতটিও ঢাবির ভোটারের আস্থায় প্রভাব ফেলেছে।

ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় এখানে নতুন পাওয়ার ডায়নামিকস এসেছে। আগের মতো মাসল পাওয়ার কে ছাত্ররা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। গত বছর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ক্যাম্পাসে পুরোনো পাওয়ার ব্লক ভেঙে গেছে। এই শূন্যতায় কারা আগে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যায় হাত দেবে সেটাই ছিল আসল লড়াই। শিবির প্যানেল এখানে এগিয়ে গেছে; ছাত্রদল মাঠে থেকেও এই শূন্যতা নিজের দিকে টানতে পারেনি। ফলে বিকল্প খুঁজতে থাকা ভোটারদের বড় অংশ শিবির প্যানেলের দিকেই গেছে। যার সরাসরি প্রভাব আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ ভাগ নারী ভোট। হলের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, ডবলিং এর যন্ত্রণা, রাতের বাস এগুলো নারী শিক্ষার্থীর বাস্তব সমস্যা। নির্বাচনের আগের সপ্তাহেই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল, মেয়েরা খুব নির্দিষ্ট চাহিদা জানাচ্ছে। শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা এই ভাষায় কথা বলায় তাদের প্রতি আস্থা বেড়েছে। ছাত্রদল যদি একই ভাষায়, একইভাবে নকশাবদ্ধ সমাধানের প্রতিশ্রুতি জোরে তুলে ধরত, ছবিটা ভিন্ন হতে পারত।

সব মিলিয়ে চিত্রটা দাঁড়ায় এমন, ঢাবির ছাত্রদল তাদের ইউনিটে বড় কোনো কুকীর্তি করেনি, সুশৃঙ্খল প্রচারও করেছে। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির নানা ঘটনার দায় তাদের কাঁধে এসে পড়েছে; মানুষ দেখেছে বিএনপি তে বহিষ্কার হচ্ছে ঠিকই, তবু বিশৃঙ্খলা, অভিযোগ থামছে না। একই সঙ্গে মাঠের সংগঠন, নারী ভোট কৌশল, দৈনন্দিন সমস্যার ভাষা সবখানে শিবির সমর্থিত জোট এগিয়ে গিয়েছিল। ফলে ভিপি-জিএস-এজিএস সবখানেই ব্যবধান বড় হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও দুটি তথ্য পরিষ্কার করা দরকার। প্রথমত, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলকে অনেকে ঢাবির প্রেক্ষাপটে টেনে আনছেন। জাহাঙ্গীরনগরে ভোট ইতিমধ্যে হয়ে গেছেভিপি স্বতন্ত্র, জিএস শিবির-সমর্থিত; কেন্দ্রীয় অধিকাংশ পদেই শিবির-ঘনিষ্ঠ প্যানেলের প্রভাব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রুকসু) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)- ভোট যথাক্রমে সেপ্টেম্বরের শেষ অক্টোবরের মাঝামাঝি নির্ধারিত। ফলে ঢাবির ফল এখনই একটি ট্রেন্ডের ইঙ্গিত দিলেও, প্রতিটি ক্যাম্পাসের নিজস্ব বাস্তবতা আলাদাএই পার্থক্য মাথায় রাখা জরুরি। দ্বিতীয়ত, এবারের ভোটে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ব্যবধান এত বড় যে শুধু অভিযোগ দিয়ে হার ব্যাখ্যা করা যাবে না; বার্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা সংগঠনএই তিন জায়গাতেই ছাত্রদল পিছিয়ে ছিল।

এখন ছাত্রদলের সামনে করণীয় কী? প্রথম কাজ, জাতীয় রাজনীতির যে অভিযোগ ঢাবির ভোটারে বিরূপ প্রভাব ফেলে, সেটির সঙ্গে নিজেদের স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি করতে হবে, কথায় নয়; পদ্ধতিতে। যেকোনো অপরাধে নির্দিষ্ট সময়সীমায় তদন্ত, তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ, দায়ীদের নাম পর্যায়ক্রমে দৃশ্যমান ব্যবস্থা, এসব ওপেন ড্যাশবোর্ডের মতো করে যোগাযোগ করতে হবে, যাতে শুধুমাত্র বহিষ্কার করেছি বলাটা ভরসায় বদলে যায়। তার পরের কাজঃ নারী শিক্ষার্থী নন-রেসিডেনশিয়ালদের জন্য টার্গেটেড সার্ভিস প্রতিশ্রুতি, রাতে বাসরুট, নিরাপদ পরিবেশ, হল খাবারের মান, লাইব্রেরি আওয়ারস সহ সবকিছুর টাইমলাইন ধরা। তৃতীয় কাজ সমন্বয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে শিবির বিরোধী এক্টিভিটি করলে কুৎসা ছড়ালে ফলাফল বদলায় না; তাই আগেভাগে সমন্বয়ের রূপরেখা, প্রার্থী বাছাইয়ের স্বচ্ছ নিয়ম বানাতে হবে। সর্বশেষ, বড় দেখানোর প্রচারের রাজনীতির সঙ্গে দৈনন্দিন ছোট সমস্যার ভাষা সমান রাখা; কারণ ভোটারদের মন জেতে হলে আগে তাদের দৈনন্দিন কষ্টকে সিরিয়াসলি নিতে হয়, এইবারের ঢাবির এই ভোট সেটাই দেখিয়েছে। এই নির্বাচনে ভিপি-জিএস-এজিএস পজিশান গুলায় যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, তাতে প্রমাণিত শুধু আবেগ নয়, ব্যবহারিক প্রতিশ্রুতি এখন ফয়সালা করে।

এক কথায়, ছাত্রদল হেরেছে মূলত আস্থার লড়াইতে। তাদের নির্বাচনি ক্যাম্পেইন অতও খারাপ ছিল না; কিন্তু জাতীয় ইমেজন সংকট, মাঠের সংগঠনে পিছিয়ে পড়া, নারী ভোট অর্জনে কৌশলে দুর্বলতা, আর বার্তার ভাষায় দৈনন্দিন সমস্যা কে কম গুরুত্ব; এই চারটি জিনিস মিলে ভোট তাদের থেকে সরে গেছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন ধরা যাক ২০২৬ এর আগেই যদি দল পর্যায়ে স্বচ্ছ শৃঙ্খলা ব্যবস্থা, ইউনিট পর্যায়ে সার্ভিস ডেলিভারি, আর সমন্বয় এই তিনটিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখাতে না পারে, তবে বড় পরিসরেও একই ছবির পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি থাকবে। ডাকসুর ফল শিক্ষার্থীরা কেবল কোন দল ভালো বলে দেয়নি; তারা বলে দিয়েছে কীভাবে ভালো হতে হয়, এখন সেটা শেখাই ছাত্রদলের চ্যালেঞ্জ।

 

লেখকঃ আবরার মোহসিন সামিন

রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্র