
সম্প্রতি ডেইলি স্টার একটি মজাদার পরিসংখ্যানের খবর বাজারে ছেড়েছে। ‘ইনোভিশন কনসাল্টিং’ নামের একটি অজানা সংস্থার সার্ভের ফল তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, অতীত নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে বঙ্গবন্ধু, শূন্য স্কোরে শেখ হাসিনা। সমস্যা হলো, এই পত্রিকার সম্পাদক এখনো মনে করেন যে আগের প্রজন্ম তো বটেই, জেন-জি প্রজন্মও ঘাস খেয়ে বড় হচ্ছে! অথচ যেকোনো বিচারে বেটি এক গোল্লা পেলে বাপের ডাবল গোল্লা পাওয়া উচিত।
অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে ডেইলি স্টার নিজে এই সার্ভেটি করেনি। যে ফার্ম সার্ভেটি করেছে, ডেইলি স্টার শুধু তার ফলটি ছাপিয়ে দিয়েছে। কষ্ট লাগে এই ভেবে যে, বিএনপি মহাসচিবসহ কিছু নেতা ও বুদ্ধিজীবী এখনো এই কাগজ দুটির পক্ষে মায়াকান্না করেন। এই পত্রিকার সম্পাদকরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এক-এগারো আমাদের ব্রেইন চাইল্ড। এখন এই পত্রিকা না থাকলে নাকি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
এই কাগজ দুটি হাসিনা জমানায় এ রকম সার্ভে প্রায়ই প্রকাশ করত। যেমন : সরকারের জনপ্রিয়তা কমলেও শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে! এভাবেই এরা ফ্যাসিবাদের সেবা দিয়ে গেছে। পরিশেষে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হলেও তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ফিরে আনার কসরত শুরু করেছে। বাপকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে বেটিকে শূন্য নম্বর দেওয়া সে রকমই এক ভেলকিবাজি! অথচ শূন্য নম্বরপ্রাপ্ত এই বেটি বাপের বাকশালি আদর্শের মতোই কাজ করেছে! বলা যায়, একেবারে বাপকা বেটি!
বেটি যেমন ‘স্বজন হারানোর বেদনা, আমার চেয়ে কে আর বেশি বুঝে’ বলে ইতিহাসের জঘন্যতম গুম-খুন করে গেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও মেয়েকে টিভির সামনে যেদিন জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেদিন তিনি ঠিকই জানতেন এই ইলিয়াস আলীকে তারই নির্দেশে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! এ ক্ষেত্রে বেটি একটু কুশলী হলেও বাপ ছিলেন বেপরোয়া। জহির রায়হানের সহোদরা ভাইয়ের গুমরহস্য উদ্ঘাটনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটু চাপ দিয়ে বলেছিলেন, ‘মুখ বন্ধ রাখাই তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে ওহে সিস্টার! তা না হলে নিজেও উধাও হয়ে যেতে পারো!’ এ যেন সিনেমার এক ভিলেনের ডায়ালগ। তারপরও তিনি ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, জিয়া সবাইকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন!
বেটি ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চোখের ডাক্তার দেখাতেন আবার সর্দি হলে লন্ডন-আমেরিকায় দিনের পর দিন চিকিৎসা গ্রহণ করতেন! এই কিসিমের চমক দেখাতে বাপও খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মানুষকে চমকে দেওয়ার জন্য বলতেন, আমার সামনে চোর, বামে চোর... অথচ এই চোরদের একটাকেও ধরেননি! বলতেন, চামচার দল চেটে সব খেয়ে ফেলছে। অথচ জনগণ স্পষ্টতই দেখতে পেত যে চামচা পরিবেষ্টিত থাকতেই তিনি পছন্দ করতেন!
বেটির ডিজিটাল লুটপাট আমরা দেখেছি! দেশ থেকে পাচারই হয়েছে ২৫০ বিলিয়ন ডলার! বেটি এই কাজটি করেছে বাপকে আইকন বানিয়ে। সেই বেটি শূন্য নম্বর পেলে খোদ আইকন সর্বোচ্চ নম্বর পায় কেমনে? মতিউর রহমান রেন্টু আমার ফাঁসি চাই বইটিতে এই ব্যান্ডিড কুইন সম্পর্কে যা যা লিখে গেছেন, ১৫/১৬ বছর দেশবাসী সেসবই যেন চাক্ষুষ দেখেছে!
অনেকেই বলবেন, আসলে মেয়েটিই খারাপ, ছি! ছি! কী বাপের কী মেয়ে হলো রে! বাপটি ছিলেন ফেরেশতার মতো, যেন আমাদের গান্ধীজি! এবার দেখুন, আমাদের সেই গান্ধী সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ কী মন্তব্য করে গেছেন তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটিতে : “The person I remember from the Ottawa meeting was Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman, the hero who had opposed Pakistan and led East Pakistan to independence as Bangladesh. He arrived in style at Ottawa in his own aircraft. When I landed, I saw a parked Boeing 707 with ‘Bangladesh’ emblazoned on it. When I left, it was still standing on the same spot, idle for eight days… As I left the hotel for the airport… two huge vans were being loaded with packages for the Bangladeshi aircraft. At the conference, Mujibur Rahman had made a pitch for aid to his country. Any public relations firm would have advised him not to leave his special aircraft standing for eight whole days on the parking apron.”
বাংলায় তরজমা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, “অটোয়া বৈঠক থেকে যাকে আমি মনে রেখেছি তাদের একজন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান—যিনি পাকিস্তানের বিরোধিতা করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নিজস্ব বিমানে চমকপ্রদ ভঙ্গিতে অটোয়ায় এসেছিলেন। আমি যখন অবতরণ করলাম, তখন একটি বোয়িং ৭০৭ বিমানকে পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তাতে বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘Bangladesh’।
আমি যখন ফিরে এলাম, তখনো সেটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, টানা আট দিন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। … আমি যখন হোটেল ছেড়ে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম দুটি বিশাল ভ্যান বাংলাদেশি বিমানের জন্য নানা প্যাকেজ বোঝাই করছে। সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। কোনো জনসংযোগ সংস্থা তাকে নিশ্চয়ই পরামর্শ দিত, বিশেষ বিমানটিকে টানা আট দিন রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেওয়া উচিত।”
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কমপক্ষে দুই যুগ ধরে জাতিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে না হয় ‘ডলা’ খাওনের ভয় ছিল। যখন ক্ষমতায় ছিল না এবং এখন যখন ক্ষমতায় নেই তখনো লি কুয়ান ইউয়ের এই অতি প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করার সাহস দেখাতে পারেনি। অথচ কোন রাষ্ট্রনায়ক বাতাসের সঙ্গে কথোপকথনে কখন বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বতমালাকে দেখি নাই কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ এগুলো যে ইনিয়ে-বিনিয়ে কতবার বলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই!
পাল্টা যদি জানতে চান, হিমালয় পর্বতমালা দেখি নাই, এই সংবাদটি কোথায় পেয়েছেন, ব্রাদার? পৃথিবীর কোন সংবাদপত্রে এটি ছাপা হয়েছিল? সূত্র হিসাবে তখন সর্বোচ্চ বলতে পারবেন যে একুশের গানের অমর স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলামে এটা পড়েছি।
বাপের এই বেটি খুশিতে গদ গদ হয়ে বলেছিলেন, আমার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছে! উনি মনে করলেন, এটুকু স্বীকার করলেই দেশবাসী তাকে যুধিষ্ঠির ঠাহর করবেন।
দেখুন বাপ-বেটির মগজের গঠন ও চিন্তার প্যাটার্নটিতেও কত্তো মিল । বাপ একই ধরনের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে এবং কৃত্রিম আক্ষেপ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি!’
দেশেরও একটা শরীর আছে, সেই শরীরে আর কত সয়? দেশটিকে তিন বছরের মধ্যেই তিনি তলাবিহীন ঝুড়িতে রূপান্তর করেন। ৯ মাসের যুদ্ধের পরপর এই দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের আগে দেশে খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও দেখা দেয়নি। ড. অমর্ত্য সেন আমাদের ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণা করে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন খাদ্যের অপ্রতুলতার জন্য নয়; বরং খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি এবং সীমাহীন দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণেই তখন দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল! ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যত না মানুষ নিহত হয়েছে, এর চেয়ে বেশি মানুষ মরেছে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে। এখন এই শেখ মুজিবকে ডেইলি স্টার গ্রুপদের সহযোগীরা সর্বোচ্চ নম্বর না দিলে আর কাকে দেবেন?
তাছাড়া বেটি ১৫/১৬ বছরে যত গুম-খুন করেছেন, বাপ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এ সময়ের মধ্যেই তার চেয়ে অনেক বেশি (৩০ হাজার) জাসদের নেতাকর্মীকে হত্যা করেছেন। সিরাজ সিকদারকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে সংসদে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়েছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?
এভাবে সব কিসিমের গুন্ডামি, প্রতারণা, জালিয়াতি, শঠতার ফাদারিং করে তিনি হয়ে পড়লেন ফাদার অব দ্য নেশন। অথচ পাক-বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে পুরো ৯ মাস ড. কামাল হোসেন সহকারে জামাই আদরেই ছিলেন এবং ঢাকায় রেখে যাওয়া পরিবারের জন্য মাসিক ১৫০০ রুপির ভাতা ব্যবস্থা করেছিলেন! নিজের মেয়ে পাক-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সিএমএইচে সন্তান জন্মদান করেছিলেন। দেশে ফিরে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে শপথ ছাড়াই রাষ্ট্রপতি বনে যান। তারপর এক প্রধানমন্ত্রী আবার রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। তিনি তার স্বেচ্ছাচারিতায় রাষ্ট্রের সবকিছু তছনছ করে দেন! এরপর তো এক্কেবারে আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। নিজের গুণকীর্তনের জন্য চারটি পত্রিকা রেখে বাদবাকি সব পত্রিকা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় যা করতে পারেননি, সেটাই তার মেয়ে করে দেখিয়েছেন।
নতুন প্রজন্ম দেখেছে, শেখ হাসিনা শিক্ষাব্যবস্থাসহ কীভাবে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন। খাতায় কিছু লেখুক আর না লেখুক, সঠিক লেখুক আর বেঠিক লেখুক—খাতায় নম্বর দিতেই হবে! এভাবে এ-প্লাসের বন্যা বইয়ে হাসিমুখে তা সেলিব্রেট করতেন এবং এই ভালো ফলকে তার সরকারের সাফল্য বলে প্রচার করতেন!
বাপের সঙ্গে বেটির এখানেও দারুণ মিল রয়েছে! ১৯৭২ সালে যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাদের আমরা ডাকতাম ‘বাহাত্তুইরা’ বলে । দেখুন, বাপ-বেটির মধ্যে কী অপূর্ব মিল। ডেইলি স্টার সেই বাপকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে বেটির প্রতি এই অবিচারটি কেন করল? দরদমাখা কণ্ঠে সেই বাপ ঘোষণা করলেন, ‘যুদ্ধের কারণে আমার ছেলেরা পড়ালেখা করতে পারে নাই।’ এই দরদ দেখেই সবাই সিগন্যাল পেয়ে গেল, স্কুলের চেয়ার-টেবিলও ফরম ফিলাপ করে বসে এবং সবাই পাস করে যায়।
তখনকার এক পরীক্ষার্থীর হৃদয়বিদারক ঘটনা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একজন হেল্পার পরীক্ষার্থীকে বলে দিচ্ছেন আর ছাত্র মহাশয় লিখে যাচ্ছে। হেল্পার বলছেন, এবার ফুল স্টপ দে! ছাত্র জিজ্ঞেস করে, ফুল স্টপ কীভাবে দেব? তখন হাত দিয়ে দেখায় এবং মুখে বলে, হারামজাদা, এভাবে কলম ধরে খাতার মধ্যে টুকা দে! একটু পরে করুণ কণ্ঠে পরীক্ষার্থী জানায়, কথামতো টোকা মারায় কলমের নিব ভেঙে গেছে!
১৯৭১ সালে যারা সোনাগাছিসহ কলকাতার নানা হোটেলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, ১৯৭২ সালে এরাই পরীক্ষার খাতায় কলমের নিব ভেঙেছেন। এরাই আবার পরে জাতির কপালটি খেয়েছেন—কেউ রক্ষীবাহিনী হয়ে ত্রাশ সৃষ্টি করেছেন, কেউ আবার সাংস্কৃতিক ও বিনোদনজগৎ থেকে এক লাফে বুদ্ধিজীবী বনে গেছেন, চেতনার একেক দিকপাল সেজেছেন। এদের রাস্তার পালোয়ান আর বুদ্ধিবৃত্তিক পালোয়ানদের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না!
সোনাগাছিফেরত মহামানবরা দেশে ফিরেই দেশে অবস্থানরত সাকল্য জনগণকেই পারলে রাজাকার বলে ট্যাগ দেওয়া শুরু করেন। তখন এনায়েতুল্লাহ খান তার কাগজে শিরোনাম করেছিলেন, ৬৫ মিলিয়ন কোলাবরেটর। অর্থাৎ যারা দেশে ছিলেন সবাই রাজাকার!
জানি না, এই চেতনাজীবীদের হাত থেকে জাতির আদৌ মুক্তি মিলবে কি না? কারণ রাজাকারের সংখ্যা সেই সাড়ে ৬ কোটি থেকে প্রায় ১৮ কোটিতে পৌঁছে গেছে!
মিনার রশীদ
লেখক : কলামিস্ট