
মাসুম খলিলী
ইইউ এবং চীনা কর্মকর্তারা বিদ্যমান বাণিজ্য বাধা নিয়ে আলোচনা করছেন এবং জুলাই মাসে চীনে একটি পূর্ণাঙ্গ শীর্ষ সম্মেলনের কথা বিবেচনা করছেন। চীন ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক অবস্থানের একটি সম্ভাব্য দুর্বলতাও দেখে। একাধিক দেশের ওপর আরোপিত ব্যাপক শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নাড়িয়ে দিয়েছে, যা ডলারের মূল্যহ্রাসে অবদান রেখেছে
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে তার ‘পারস্পরিক শুল্কের’ ওপর একটি কৌশলগত বিরতি ঘোষণা করেছেন, যা প্রায় ১০০টি দেশকে প্রভাবিত করে। ট্রাম্প অবশ্য, একই সাথে চীনা আমদানির ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশে উন্নীত করেছেন। এই পদক্ষেপটি গত ফেব্রুয়ারি থেকে অব্যাহত থাকা চীনের টিট-ফর-ট্যাট প্রতিশোধের সরাসরি প্রতিক্রিয়া। চীন ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প আশা করেছিলেন শুল্কারোপের পর চীনের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ফোন করবেন অথবা আলোচনার প্রস্তাব দেবেন। কিন্তু শি জিন পিং সেটি না করে পাল্টা শুল্কারোপের পাশাপাশি বার্তা দিয়েছেন যে, ‘এ ধরনের শুল্কযুদ্ধে কেউ জয়ী হতে পারে না।’
ট্রাম্প তার বাণিজ্যযুদ্ধের নিশানা শুধু চীনকে করলে তার একরকম প্রতিক্রিয়া হতো। কিন্তু এই যুদ্ধ শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার বিরুদ্ধেই ঘোষণা করেছেন। এর ফলে ক্ষুব্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নও ট্রাম্পের শুল্ক হারের সমপরিমাণ পাল্টা শুল্কারোপ করেছে। আর ট্রাম্প নতুন শুল্ক স্থগিত করলে ইইউও একই পদক্ষেপ নেয়। তবে এর মধ্যে ভয়ানক যে বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য ঘটে গেছে, সেটি হলো ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। এই উদ্যোগের মূল কথা হলো যুক্তরাষ্ট্র বা চীন দু’পক্ষের কারো ওপর নির্ভর না করে বাকিদের সাথে জোট ও বোঝাপড়া তৈরি করা।
এসব পদক্ষেপ শুধু ট্রাম্প ব্যক্তি হিসেবেই নন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও প্রভাবকেও প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিতে পারেন। কারণ ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এতদিন যে ব্যবস্থার কথা ব্রিকসের নেতাদের কাছে শোনা যেত সেটি এখন ইইউ নেতাদের মুখে চলে এসেছে। আর ডলার হলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি রেডলাইন। এই রেডলাইন নিয়ে কথাবার্তা উঠতেই ডলারের দামে উদ্বেগজনক পতন লক্ষ করেছেন আমেরিকান অর্থনীতিবিদরা।
সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একসময় ডলারের পেছনে স্বর্ণের সমর্থন থেকে সরে এসে জ্বালানি বেচাকেনার মাধ্যম হিসাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করে মান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন তেল রফতানিকারক সৌদি আরবসহ অন্যরা বিকল্প মুদ্রায়ও জ্বালানি বিক্রির সমঝোতায় যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি নির্বিচারে ডলার প্রিন্ট করার অভিযোগে রিজার্ভ ও বিশ্ববাণিজ্য কারেন্সি হিসেবে ডলার তার মর্যাদা হারাতে শুরু করে। এ অবস্থায় আরেক দফা ডলারের মূল্যের অবনতি ঘটায় ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ।
বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধানে ইউরোপ
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ শুরু করার পর পশ্চিমের বাকি দেশগুলো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ব্রিটেন, কানাডা ও অন্যরা ওয়াশিংটনের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে চাইছে। এর অর্থ হলো ডলার থেকে নিজেদের মুক্ত করা, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো এবং উদীয়মান অর্থনীতির কাছে পৌঁছানো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কার্যত বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যব্যবস্থার মাধ্যমে তার ধ্বংসাত্মক বলকে সুইং করেন এবং পূর্বের কট্টর আমেরিকান মিত্রদের টার্গেট করে অন্যান্য উন্নত দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া একটি নতুন বলয় গঠনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি পশ্চিমারা যদি একসাথে কাজ করে তবে তারা আরও শক্তিশালী হতে পারে। ট্রাম্প এমন কোনো উদ্যোগ অপছন্দ করবেন যাতে অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধ বাহিনীতে যোগদান করে। তিনি ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার বিশৃঙ্খল শুল্কনীতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া সমন্বয় না করার জন্য যেন নতুন ট্যাব না খোলেন।
গত সপ্তাহে বাণিজ্যযুদ্ধে ট্রাম্পের ব্যাপক ইউ-টার্ন বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থান দুর্বল করেছে। তবে এখনো তার উল্লেখযোগ্য শক্তি বা লিবারেজ রয়ে গেছে। ফলে বাকি পশ্চিমারা তার অকারণে বিরোধিতা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করছেন।
ডলার ধ্বংসের জল্পনা!
ট্রাম্প তার পদক্ষেপে শুধু বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাই ভেঙে দিচ্ছেন না, এটি ডলারের প্রতি বিশ্বাসও ক্ষুণ্ন করছে। এটি পশ্চিমের বাকি অংশের জন্য একটি সুযোগের পাশাপাশি হুমকিও। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামনে ইউরোর উন্নতি ঘটানোর সুযোগ এসেছে, যাতে অফিসিয়াল রিজার্ভের ২০ শতাংশ রয়েছে। এটি আর্থিক ব্ল্যাকমেলে ওয়াশিংটনের ক্ষমতা হ্রাস করার সাথে সাথে ইইউর ঋণের খরচও কমিয়ে দেবে।
ইইউ তার নিজস্ব বন্ড ইস্যু করে ইউরোর স্থিতি বাড়াতে পারে, যা তারল্য বৃদ্ধি করবে। তবে যদি এটি তার সশস্ত্রবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য অর্থ ব্যবহার করে তাহলে এটি দ্বিগুণ সুবিধা পাবে। যতক্ষণ ইইউ নিজেকে রক্ষা করতে না পারে ততক্ষণ এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়ের দ্বারা ধমক খাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
এক্ষেত্রে একটি দক্ষ, আন্তঃসীমান্ত প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার জন্য অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে একত্র হওয়া সর্বোত্তম পন্থা হবে। এটি সামরিক বিনিয়োগে এখনকার মন্দা বন্ধ করতে সাহায্য করলেও ট্রাম্প সেটা পছন্দ করবেন না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের নিরাপত্তার জন্য আরো বেশি ব্যয় করার জন্য চাপ দিচ্ছে, তবে এটি দিচ্ছে আমেরিকান অস্ত্র বিক্রির জন্য।
পশ্চিমকে ছাড়িয়ে আরো দূরে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ইইউর পশ্চিমের বাকি বলয়গুলোর কেন্দ্রে থাকা দরকার। রয়টার্সের কলামিস্ট হুগো ডিক্সন মনে করেন, ব্রিটেনের সাথে একটি সাহসী নতুন সম্পর্ক হতে পারে এর প্রথম পদক্ষেপ। এর পরে, অগ্রাধিকার হবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অন্যান্য বৃহৎ ‘পশ্চিমা মিত্র’ অর্থনীতিগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপন করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যানুসারে সমষ্টিগতভাবে, ইইউ এবং অন্যান্য বড় পশ্চিমা দেশগুলো গত বছর বিশ্ব উৎপাদনের ৩০ শতাংশ অবদান রেখেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (২৭ শতাংশ) চেয়ে বেশি। এ সময়ে চীনের উৎপাদন ছিল ১৭ শতাংশ।
হুগো ডিক্সন মনে করেন, এই প্রসারিত পশ্চিমা বলয়টি এরপর বৃহৎ উদীয়মান অর্থনীতির, বিশেষ করে ব্রাজিল, ভারত, মেক্সিকো, তুরস্ক এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আসিয়ান-৫ গ্রুপের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এই দেশগুলো গত বছর বিশ্ব উৎপাদনে ১১ শতাংশ অবদান রেখেছে। তারা সবাই নতুন বাণিজ্য অংশীদার খুঁজবে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর শুল্কারোপ করে রাখে।
পশ্চিমের এই দেশগুলো এবং ‘গ্লোবাল সাউথ’ যত বেশি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাধা কমিয়ে দেবে, তত বেশি তারা ট্রাম্পের নীতির আঘাত প্রশমন করতে পারবে।
দ্বৈত নির্ভরতা কাটানো
পশ্চিমের বাকি দেশগুলো নিজেদের মধ্যে এবং উদীয়মান অর্থনীতির সাথে সহযোগিতা বাড়াতে যত বেশি উচ্চাভিলাষী হবে, চীনের ওপর নির্ভর করার ঝুঁকি তত কম হবে। চীনা ঝুঁকির কারণে অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধ বাহিনীতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং অনেক আসিয়ান দেশও বেইজিংয়ের দ্বারা হুমকি অনুভব করে। ইউরোপে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে পরোক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে রাশিয়ার প্রধান সমর্থক চীন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা আমদানিতে ১৪৫ শতাংশ শুল্কারোপ করার পর বেইজিং এখন তার পণ্যগুলোর জন্য নতুন বাজার খুঁজবে। সে ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলো অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করে তাদের শিল্পকে রক্ষা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রফতানি কঠোরভাবে কমিয়ে দেয়ার কারণে এখন প্রচুর পরিমাণে চীনা বিরল খনিজ কেনার সুযোগ তৈরি হতে পারে। ইউরোপ ও জাপানও নবায়নযোগ্য শক্তির রোল-আউট দ্রুত-ট্র্যাক করতে এবং আমেরিকান গ্যাসের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে চীনা সৌর প্যানেলে দৃষ্টি দিতে পারে।
উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যুতে চীনকে সহযোগিতা করতে পারে। তবে তাদের এখনো অনেক বিষয়ে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একই সময়ে ওয়াশিংটন ও বেইজিং উভয়ের ওপর নির্ভরতা কাটাতে সময় লাগবে এবং তা ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু বাকি পশ্চিমারা তা না করলে একসময় তাদের আফসোস করতে হতে পারে।
ট্রাম্পের যুদ্ধ মোকাবেলা করবে চীন!
ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে চীনের সাথে তার বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধে একটি নিষ্পত্তিমূলক এবং দীর্ঘস্থায়ী বিজয় নিশ্চিত করার অনন্য সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন অনেক চীনা বিশেষজ্ঞ।
বাস্তবতা হলো ট্রাম্প যা ভাবেন তার চেয়ে বেশি বাণিজ্যযুদ্ধের কার্ড ধারণ করছে চীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক অংশীদারদের ওপর শুল্কারোপ করার তার পরিকল্পনা থেকে তিন মাসের জন্য ফিরে আসেন, তখন মূল ব্যতিক্রম ছিল চীন। সব মার্কিন বাণিজ্য অংশীদারের ওপর নতুন ১০ শতাংশ শুল্কের বাইরে বাকি বিশ্বকে ৯০ দিনের শুল্ক ছাড় দেয়ায় চীন আরও বেশি চাপ অনুভব করবে। ৯ এপ্রিল ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছেন।
অনেক দেশ ট্রাম্পের বিলম্বিত পারস্পরিক শুল্ক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিবর্তে আলোচনা ও সংলাপের পক্ষপাতী হওয়ার কথা বললেও বেইজিং পাল্টা ব্যবস্থার সাথে প্রতিক্রিয়া জানানোর একটি ভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১১ এপ্রিল, চীন ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘তামাশা’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজস্ব শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছে। প্রতিশোধ হিসেবে, ট্রাম্প পরে কিছু ইলেকট্রনিক্সের জন্য ছাড় ঘোষণা করার আগে চীনের ওপর তার শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করেন।
চীনের পরিবর্তিত সমীকরণ
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীনের রফতানিমুখী নির্মাতাদের জন্য শুল্কের পরিণতি গুরুতর, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে যারা আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য আসবাবপত্র, পোশাক, খেলনা এবং গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদন করে। কিন্তু ট্রাম্প প্রথম ২০১৮ সালে চীনের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির সূচনা করার পর বেশ কয়েকটি অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক কারণ বেইজিংয়ের গণনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছে। ২০১৮ সালে, প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধের শুরুতে, মার্কিন-গামী রফতানি চীনের মোট রফতানির ১৯.৮ শতাংশ ছিল।
২০২৩ সালে, এটি ১২.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এই শুল্ক তার ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্প্রসারণ’ কৌশলকে ত্বরান্বিত করতে এবং তার দেশীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্ররোচিত করতে পারে। সম্ভবত এক দীর্ঘায়িত মন্দা চীনা অর্থনীতিকে ধাক্কার জন্য আরো স্থিতিস্থাপক করে তুলেছে। চীন আরো বোঝে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজেই চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা প্রতিস্থাপন করতে পারে না। যদিও চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আমদানি হ্রাস পেয়েছে, তবে এখন তৃতীয় দেশ থেকে আমদানি করা অনেক পণ্য চীনা কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে।
২০২২ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫৩২টি প্রধান পণ্য বিভাগে চীনের ওপর নির্ভরতা ২০০০ সালের স্তরের প্রায় চারগুণ, যেখানে একই সময়ে মার্কিন পণ্যের ওপর চীনের নির্ভরতা অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া আমেরিকান ভোক্তাদের, বিশেষ করে নীল-কলার ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। বেইজিং বিশ্বাস করে ট্রাম্পের শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বাড়াবে।
প্রতিশোধের ড্রাগনীয় হাতিয়ার
পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিবেশের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চীনের বেশ কয়েকটি কৌশলগত হাতিয়ারও রয়েছে। চীন বৈশ্বিক বিরল আর্থ সরবরাহ শৃঙ্খলে আধিপত্য বিস্তার করে। সামরিক ও উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু অনুমান অনুসারে, মার্কিন বিরল খনিজ আমদানির প্রায় ৭২ শতাংশ সরবরাহ করে চীন।
পোলট্রি ও সয়াবিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৃষি রফতানি খাতকে লক্ষ্য করার ক্ষমতাও ধরে রেখেছে চীন। এই শিল্পগুলো চীনা চাহিদার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং রিপাবলিকান- রেড জোনে থাকা রাজ্যগুলোতে তা কেন্দ্রীভূত। চীন মার্কিন সয়াবিন রফতানির প্রায় অর্ধেক এবং পোলট্রি রফতানির প্রায় ১০ শতাংশ আমদানি করে। ৪ মার্চ, বেইজিং তিনটি প্রধান মার্কিন সয়াবিন রফতানিকারকের জন্য আমদানি অনুমোদন প্রত্যাহার করে।
অ্যাপল ও টেসলার মতো অনেক মার্কিন কোম্পানি প্রযুক্তিগত দিক থেকে চীনা উৎপাদনের সাথে গভীরভাবে আবদ্ধ। ট্রাম্পের ট্যারিফ তাদের লাভের মার্জিনকে উল্লেখযোগ্যভাবে সঙ্কুচিত করতে পারে। এ কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন সিনিয়র ব্যক্তি ইলন মাস্ক শুল্কের বিরুদ্ধে মার্কিন বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর সাথে বিরোধে জড়িয়েছেন।
চীনের কৌশলগত উদ্বোধন?
যদিও বেইজিং মনে করে যে এটি দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ট্রাম্পের ব্যাপক শুল্ক মোকাবেলা করতে পারে, তবে সেই সাথে এটিও বিশ্বাস করে যে, তার নিজস্ব ব্যবসায়িক অংশীদারদের বিরুদ্ধে মার্কিন শুল্কারোপ আমেরিকান আধিপত্যকে স্থানচ্যুত করার কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে।
এটি পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে উল্লেখযোগ্যভাবে পুনর্নির্মাণ করতে পারে। ৩০ মার্চ ট্রাম্প বেইজিংয়ের ওপর প্রথম শুল্ক বৃদ্ধি করার পরে চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের প্রথম অর্থনৈতিক সংলাপের আয়োজন করে এবং একটি ত্রিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অগ্রসর করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বাইডেন প্রশাসনের সময় একটি প্রধান কৌশলগত আঞ্চলিক অগ্রাধিকার অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ট্রাম্পের শুল্ক চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিতে পারে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ১১ এপ্রিল ঘোষণা করেছে যে, রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ‘সর্বত্র সহযোগিতা’ আরও গভীর করার লক্ষ্যে ১৪-১৮ এপ্রিল ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং কম্বোডিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফর করবেন।
ট্রাম্প দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ার পণ্যের ওপর ২৪ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন। ট্রাম্পের শুল্ক কৌশল ইতোমধ্যে চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার চিন্তাভাবনা করতে প্ররোচিত করেছে। এটি এমন কিছু যা ট্রান্সআটলান্টিক জোটকে দুর্বল করতে পারে।
৮ এপ্রিল, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন করেন। এ সময় উভয়পক্ষই যৌথভাবে মার্কিন বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের নিন্দা করেন এবং অবাধ ও উন্মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে কথা বলেন। কাকতালীয়ভাবে, ৯ এপ্রিল, যেদিন চীন মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও নির্বাচিত মার্কিন আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করে।
এখন, ইইউ ও চীনা কর্মকর্তারা বিদ্যমান বাণিজ্য বাধা নিয়ে আলোচনা করছেন এবং জুলাই মাসে চীনে একটি পূর্ণাঙ্গ শীর্ষ সম্মেলনের কথা বিবেচনা করছেন। চীন ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক অবস্থানের একটি সম্ভাব্য দুর্বলতাও দেখে। একাধিক দেশের ওপর আরোপিত ব্যাপক শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নাড়িয়ে দিয়েছে, যা ডলারের মূল্যহ্রাসে অবদান রেখেছে।
ঐতিহ্যগতভাবে, ডলার এবং মার্কিন ট্রেজারি বন্ডকে হেভেন অ্যাসেট হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক বাজারের অস্থিরতা সেই অবস্থার ওপর সন্দেহ জাগিয়েছে। যদিও ট্রাম্পের শুল্ক অনিবার্যভাবে চীনা অর্থনীতির অংশগুলোকে আঘাত করবে, বেইজিংয়ের কাছে এই সময়ে খেলার জন্য অনেক বেশি কার্ড রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
গ্লোবাল টাইমসের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সূচিত বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার তরঙ্গ চীনের বিশাল জাহাজের অবিচল গতিপথকে পরিবর্তন করতে পারে না, এটি চীনা সমাজের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছা এবং সম্মিলিত শক্তিকে নাড়া দিতে পারে না, যেখানে সবাই একসাথে কাজ করে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান সম্প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, বাণিজ্যযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিনা জয়ের যুদ্ধে’ ঠেলে দিয়েছে। এই অর্থে, চীন বাণিজ্যযুদ্ধে পিছিয়ে পড়বে না, এর প্রয়োজনও নেই।