
নানা সংকটে জর্জরিত দেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিককালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে, যার অন্যতম কারণ সামর্থ্য থাকার পরও অনেকের ঋণ পরিশোধ না করা। এ ধরনের খেলাপিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে। এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপির কারণে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, অন্যদিকে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংকিং কাঠামো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারী, সৎ ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকগুলো। গত বছর থেকেই এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ৩৫টি ব্যাংক তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকাও দিয়েছে। তবে এখনো এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতের সংকট দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হলেও আগের সরকার খাতটির বিভিন্ন সূচকের তথ্য গোপন করায় তা সামনে আসেনি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ খাতের প্রকৃত তথ্য সামনে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এখন ব্যাংক খাতের সব সূচকই নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। বিশেষ করে আগের সরকারের আমলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হলেও বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপের কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ওই তালিকা তৈরি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করে এরই মধ্যে ৩৫টি ব্যাংক তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। এসব খেলাপি গ্রাহকের কাছে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি আটকে আছে। কিন্তু এত বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশের পরও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো আইনি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ ব্যবস্থা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকগুলো নিজেরাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকদের চিহ্নিত করেছে। এখন ব্যাংকগুলো চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে অনেক ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী খেলাপিদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে। এসব তালিকা নিয়ে পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চতুর্থ প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংক ১১৯ জন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে শনাক্ত করেছে। এসব গ্রাহকের কাছে মোট ৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা আটকে আছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৮৮ শতাংশ। এর মধ্যে ২৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা চিহ্নিত হয়েছে ‘ব্যাড লোন’ বা কুঋণ হিসেবে, যা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে এ তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল, যা বর্তমান সরকারের আমলে সামনে আসছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমাদের দেশে অনেক গ্রাহক আছেন, যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। তাদের প্রকাশ্যে আনা উচিত এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে এমন আইন রয়েছে, যেখানে ঋণ পরিশোধ না করলে নাগরিক সুবিধা পর্যন্ত বাতিল করা হয়। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা, তা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রায় ১৫ গুণেরও বেশি বেড়েছে। বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতের এ ‘ক্যান্সার’ রোধ করা যায়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকের অনুমোদন ও ঋণ বিতরণের নীতিমালা লঙ্ঘন করে যাকে-তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগ রয়েছে বহু মহলের। কিছু কিছু ব্যবসায়ী নতুন ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন, আবার অনেকেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ শোধ করেননি।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মার্চে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির জন্য একটি নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ইউনিট গঠন করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন-ভিত্তিক খেলাপি ঋণের হিসাব ধরে চিহ্নিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন না, নতুন ট্রেড লাইসেন্স বা কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন নিতে পারবেন না, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবেন না, এমনকি রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার বা সম্মাননাও পাবেন না। গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনেও নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ বিধিনিষেধ কার্যকর হলে ব্যবসায়িকভাবে টিকে থাকার জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ পরিশোধ ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, ‘এ উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। দেশের ব্যাংকিং খাতকে রক্ষায় এমন ব্যবস্থা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত সরকারের আমলে এ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিভিন্নভাবে তাদের সুবিধা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রচলিত আইনে বিচার করে সম্পত্তি ক্রোক করে ব্যাংকের পাওনা আদায় করা উচিত। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যেমন পাসপোর্ট জব্দ, সন্তানের স্কুলে ভর্তি নিষিদ্ধ, এমনকি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকেও তাদের বিরত রাখা যেতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত মার্চ পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য অর্থাৎ ব্যাড লোনের পরিমাণ ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ। এ চিত্র বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে সৎ ও সাধারণ গ্রাহকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।