Image description

জনতা ব্যাংক এক সময় দেশের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে গত ১৫ বছর আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণহীণভাবে ঋণ দিয়ে ব্যাংকটি নাজুক অবস্থায় পড়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন ঋণ দেওয়া শুরু হয় সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের সময়।

তার সময় এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে উদারহস্তে ঋণ দেয় ব্যাংকটি। আবার শীর্ষ ঋণখেলাপি বেক্সিমকোকে আরেক চেয়ারম্যান এসএম মাহফুজুর রহমানের সময় ইচ্ছামতো ঋণ দেওয়া হয়। এভাবে দেওয়া ব্যাংকের মোট ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭১ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায় না হওয়ায় ডুবতে বসেছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

জনতা ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবর রহমান আমার দেশকে বলেন, বড় গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। তাদের ঋণ স্থিতি বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি বাড়ছে। ছোটদের থেকে আমাদের আদায় পরিস্থিতি ভালো। আমরা সব প্রক্রিয়ায় আদায়ের চেষ্টা করছি। এ ছাড়া গত চার মাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। এখন তারল্য পরিস্থিতি ভালো আছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা ঋণ, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ঋণের ৭২ শতাংশ বা ৬৭ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে জনতার খেলাপি ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ব্যাংকটির খেলাপি দ্রুত বেড়েছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে, যা আগে নিয়মিত দেখানো হতো।

গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কয়েকটি বড় ঋণগ্রহীতার মধ্যে কেন্দ্রীভূত। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৬৮ শতাংশই আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ শীর্ষ আট গ্রুপের। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতার ঋণে একের পর এক নতুন কোম্পানি খুলেছে বেক্সিমকো গ্রুপ এবং তার অন্যতম কর্ণধার সালমান এফ রহমান। কিন্তু ঋণ শোধ সেভাবে করেনি গ্রুপটি। বর্তমানে সালমান এফ রহমান কারাগারে থাকায় ঋণ আদায় নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগ্রাসী কায়দায় ব্যাংকটি থেকে ঋণ নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার ৩ কোটি টাকাই এখন খেলাপি।

বেক্সিমকো ছাড়া ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে আরো রয়েছে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া এননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা, চামড়া খাতের আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিন হাজার ৫১ কোটি, রতনপুর গ্রুপের এক হাজার ২২৭ কোটি, রিমেক্স ফুটওয়্যারের এক হাজার ১৩৪ কোটি, রাঙ্কা গ্রুপের এক হাজার ১৭৩ কোটি এবং গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপের ৯৬৯ কোটি টাকার খেলাপি রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটি জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেই সংকট গভীর হয়েছে।

ঋণ অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা ও পর্ষদ সদস্যদের চিহ্নিত করতে জনতা ব্যাংকের ফরেনসিক অডিটের তাগিদ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষক ও খাত বিশেষজ্ঞরা।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত যারা এসব ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং অধিকাংশ কর্মকর্তা আগের জায়গায়ই বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। সেই ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণে শীর্ষে। গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে ব্যাংকটিতে, যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা পরিচালকরা। এই ১৫ বছর ব্যাংকটির নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী সমর্থকরা।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল বারকাতকে। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি পাঁচ বছর এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার সময় এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপকে উদারহস্তে ঋণ দেয় ব্যাংকটি।

এরপর ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ উজ জামান। ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন সালমান এফ রহমান ঘনিষ্ঠ দোহা টেকের লুনা শামসুদ্দোহা। ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদ।

২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসএম মাহফুজুর রহমান। তার সময় বেক্সিমকো গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে ইচ্ছামতো ঋণ বের করে নেয়।

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদেও আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা নিয়োগ পান। ওই সময় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বলরাম পোদ্দার, নাগিবুল ইসলাম দীপু, মো. আবু নাসের ও মো. মাহবুবুর রহমান হিরন ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন। দলীয় লোকদের পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন পেশাদার সদস্যরাও। এ ছাড়া সরকারের আমলা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরাও পর্ষদে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তাদের কেউ-ই প্রভাবশালীদের ঋণ আটকাতে পারেননি। ফলে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা দিন দিন শুধু খারাপই হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের টানা শাসনামলে ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে ছিলেন এসএম আমিনুর রহমান, মো. আবদুস সালাম, আবদুছ ছালাম আজাদ ও আবদুল জব্বার। আমিনুর রহমান ও আবদুস সালাম দুজনই চাকরি শেষে যোগ দেন এস আলম গ্রুপের দুই ব্যাংকে। আবদুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও শীর্ষ তিন খেলাপি গ্রাহকের তদবিরে তাকে এমডি করে সরকার।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে জনতা ব্যাংক প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বড় অংকের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মার্চ শেষে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ২০ কোটি টাকায়, যা ডিসেম্বরে ছিল ২২ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি বেড়ে ৪৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন সংরক্ষণের কথা ছিল পাঁচ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। সেখানে উল্টো ৪৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে এমন নাজুক অবস্থা কখনো হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী আমার দেশকে বলেন, জনতা ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আশি-নব্বই দশক থেকে খেলাপিতে ডুবছে। কারণ ঋণ দেওয়ায় দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি ছিল। বিগত সরকারের সময়ও অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বের করে নেওয়া হয়। এর বেশিরভাগই পাচার করা হয়েছে, যা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণ অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা ও পর্ষদ সদস্যদের চিহ্নিত করতে জনতা ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট করা দরকার ছিল। গত ১০ মাসে সেরকম কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। এভাবে চলতে থাকলে খেলাপি বাড়তে থাকবে। এক সময় ব্যাংকটি কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলবে।