ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দুই লেনের। কিন্তু বরিশাল নগরীর চৌ-মাথা এলাকায় সেটি হয়ে গেছে এক লেন! অর্ধেকটা দখল করে সড়ক ও জনপথের জমিতে তৈরি করা হয়েছে পার্ক। ৯ কোটি টাকার নির্মাণকাজে অর্থের জোগান দিয়েছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাহান আরা বেগম পার্ক’। সিটি মেয়র থাকাকালে জনগণের টাকায় মায়ের নামে পার্কটি করেন সাদিক আব্দুল্লাহ। যেটি এখন সেখানে নিত্যযানজট আর দুর্ঘটনার বড় কারণ।
সেখানে না হয় ‘পার্ক তৈরির উদ্যোগ’ নিয়েছিলেন সাদিক। কিন্তু বরিশালের এমন অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে ছিটেফোঁটা অবদানও নেই সাদিক বা তার বাবা হাসানাত আব্দুল্লাহ বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের। কিন্তু এগুলো তাদের নামে!
অবশ্য সাদিক নয়, সরকারি আর ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া প্রতিষ্ঠানের নাম ছিনতাই করে বাবা ভাই ছেলে আর বোনের নামে করার প্রক্রিয়া বরিশালে শুরু করেন তার বাবা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। সম্পর্কে যিনি পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। যদিও এই নামকরণে শেখ মুজিবুর রহমান বা মুজিব পরিবারের কাউকেই তালিকায় রাখেননি তিনি। বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ছেলে সুকান্ত আব্দুল্লাহ, ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত আর বোন আরজু মনি’র নামেই করেছেন সব। এমনও হয়েছে যে সরকারিকাগজপত্রে এক নাম লেখা থাকলেও জোড় করে সেখানে বাবা’র নামের সাইনবোর্ড দিয়েছেন বসিয়ে। এমনকি বরিশাল প্রেস ক্লাবের নামের আগে পর্যন্ত বাবার নাম বসাতে বাধ্য করেন বর্তমানে পলাতক এই আওয়ামী লীগ নেতা। ৫ আগস্টের পর অবশ্য সেই নাম বদলে পুরোনো নামে ফিরেছে প্রেস ক্লাব।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নিজের জমিতে নিজের টাকায় প্রতিষ্ঠান করে বাবা-মা’র নাম দিলে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু তা না করে বরিশালের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের নাম ছিনতাই করেছেন বাবা-ছেলে। সর্বশেষ অশ্বীনি কুমার দত্তের দানে গড়া সরকারি বরিশাল কলেজের নাম মায়ের নামে করার মিশনে নেমেছিলেন সাদিক। তবে সাধারণের বাধার মুখে তা সফল হয়নি।’
বরিশালে উল্লেখ করার মতো যত শিক্ষা বা পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান, বড় ভবন বা সেতু রয়েছে তার অধিকাংশই এখন দাঁড়িয়ে আছে হাসানাতের বাবা বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়াম, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাহান আরা বেগমের নামে ২টি পার্ক এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইনজীবী সমিতি নামে দুটি ভবন।
হাসানাত আব্দুল্লাহ’র নির্বাচনি এলাকা গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায়ও ঘটেছে একই ঘটনা। ওই দুই উপজেলায় নাম ছিনতাই হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গৌরনদী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মিলনায়তন, সুকান্ত বাবু মিলনায়তন, সরকারি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ডিগ্রি কলেজ, সুকান্ত আব্দুল্লাহ মিলনায়তন আগৈলঝাড়া, আরিফ সেরনিয়াবাত নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয় গৈলা এবং সুকান্ত আব্দুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আগৈলঝাড়া। এর বাইরেও জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের নামে নানা প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই হাসানাত আব্দুল্লাহ বা তার পরিবারের কারো নিজ উদ্যোগে গড়া নয়। নেই জমি কিংবা বড় অংকের টাকা দেওয়ারও নজির। কেবল ক্ষমতার জোড়ে বহু বছর আগের নাম পালটে বসানো হয় সেরনিয়াবাত পরিবারের নাম। এমনও হয়েছে সরকারি দলিলে অন্য নাম থাকলেও বাবার নামে সাইনবোর্ড দিয়ে জোড় করে সবাইকে সেই নাম বলতে বাধ্য করতেন হাসানাত ও তার পরিবার। যেমন, কীর্তনখোলা নদীর ওপর থাকা দপদপিয়া সেতুর নাম। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কাগজ-পত্রে এই সেতুর নাম দপদপিয়া সেতু। অথচ সেতু সংলগ্ন টোল আদায়ের বোর্ড থেকে শুরু করে সব সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু। গৌরনদীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু আব্দুল্লাহ খান বলেন, ‘এখানে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট সরকারিভাবে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নামে। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম কাগজে কলমে ‘গৌরনদী মিলনায়তন’। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সাইনবোর্ড কিভাবে এল জানি না।’
অন্যের গড়া প্রতিষ্ঠানেও নিজেদের নাম দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে হাসানাতের। তেমন দুটি প্রতিষ্ঠান বরিশালের আরজু মনি ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নগরে থাকা দুটি সরকারি স্কুল শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না দেখে ওই দুটি নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক মেয়র মরহুম শওকত হোসেন হিরন। তার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠার পর রুপাতলী ও কাউনিয়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে প্রায় ২ বছর চলে স্কুল দুটি। দুর্ঘটনায় মারা যান হিরন। এর মাত্র দু’বছরের মাথায় নাম পালটে যায় এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হক বলেন, ‘শওকত হোসেন হিরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল দুটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার ইতিহাস সবার জানা। চাইলেই নিজের কিংবা তার পরিবারের কারও নামে এসব স্কুল করতে পারতেন হিরন। অথচ শেষ পর্যন্ত আর থাকেনি তার দেওয়া দুটি নাম।’
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম এভাবেই ছিনতাই করেন হাসানাত ও সাদিক। বরিশাল বারের এপিপি অ্যাডভোকেট সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছর পর বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয় নাম হঠাৎ করে হয়ে গেল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইন মহাবিদ্যালয়। মেয়রের ক্ষমতা খাটিয়ে ২০২১ সালে এই নাম বদলে দেন তৎকালীন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ।’
বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মন্টু বলেন, ‘আইনজীবী সমিতির নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বরিশাল আইনজীবী সমিতি ভবনের নামও পালটে করা হয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আইনজীবী সমিতি ভবন। এমনকি সরকারি অর্থে নির্মিত ৪ তলা এক্সটেনশন ভবনের নামও তার বাবার নামে রাখতে বাধ্য করেন হাসানাত। একইভাবে বদলে গেছে বরিশাল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও বরিশাল স্টেডিয়ামসহ অনেক ঐতিহ্যবাহী নাম।
বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘যতদূর জানি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট দু’টির নাম বদলের প্রস্তাব করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। জেলায় বিতর্কিত নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কিনা তা জানতে চেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এরকম কোনো চিঠি আমরা এখনো পাইনি। নাম পরিবর্তনের বিষয়টি যেহেতু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তাই চাইলেও আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। সরকারি সিদ্ধান্ত আসার পর এসব নাম থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারে বলা যাবে।’