Image description

দিন যতই যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠ ততই গরম হচ্ছে। মূলত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরাজিত আওয়ামী লীগের বিচারসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা এখন তুঙ্গে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবের কিছু মন্তব্য ঘিরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও কিন্তু চুপ নেই। তারাও বিএনপির বিভিন্ন বক্তব্য এবং দাবির বিষয়ে সমালোচনার সুরে কথা বলছেন। রাজনীতিবিদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও সরকারের দায়িত্বশীলদের প্রতিদিনের নানা মন্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—রাজনীতি কী তাহলে প্যাঁচের আবর্তে পড়েছে? তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে যা কিছু হচ্ছে তার সবই সংশ্লিষ্টদের কৌশল। রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারের এই টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা আলোচনা।

গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। বিএনপি মহাসচিবের ওই মন্তব্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও বিএনপির বক্তব্যের সুরকে আওয়ামী লীগের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। গত শুক্রবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিএনপির কথার টোন কিন্তু আওয়ামী লীগের টোনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও দৃষ্টি আকর্ষণকারী মতবিরোধ চলছে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের মানুষ কোন ধরনের নির্বাচন চায়, সেটি না জেনে সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবাইকে আবারও প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় কেউ যদি বাধা দিতে চায়, তাদের পরিণতি হবে শেখ হাসিনার মতোই। তিনি বলেন, ৭২-এর সংবিধান দিয়ে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র সম্ভব নয়। তাই গণপরিষদের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংবিধান প্রয়োজন।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে যে, রাজনীতিতে যেখানে ঐক্য থাকার কথা সেখানে কি ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে? কেননা, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যেভাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, সেটি কি তাহলে ফিকে হতে শুরু করেছে। রাজনীতিকদের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডে সেটিই ফুটে উঠছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে যে কোনো মূল্যে ঐক্য ধরে রেখে সামনে এগোনোর কথা বলছেন তারা। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ও সমালোচনা থাকবে। তবে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিভিন্ন মহলের বক্তব্যে উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা দেখা গেলেও নাহিদ ইসলাম ও মির্জা আব্বাস দেশ গঠনে সংঘাত এড়িয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও সরকারের এই টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা আলোচনা।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এই সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত বছরের ২৪ আগস্ট দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রশ্নে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি জানান। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই সংসদ নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানায়। তবে সেই সংস্কার যাতে অনন্তকাল ধরে না হয়। এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস তার সরকারের যে কর্ম পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে নির্বাচন প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় ‘হতাশা’ প্রকাশ করে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। সর্বশেষ প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন ইস্যুতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। এমতাবস্থায় বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের পক্ষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে।

জানা গেছে, মূলত সাড়ে পাঁচ মাসেও সংস্কার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে—এ প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এমন অবস্থায় গত বুধবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ তার ওই বক্তব্যকে উদ্দেশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বিএনপি এক-এগারো ও মাইনাস টু-এর আলোচনা শুরু করেছে, যা সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে।’ একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির অবস্থান দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উসকে দিতে পারে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে বর্তমান সরকারকে ‘অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানান। নাহিদ ইসলাম মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতার এ ধরনের মন্তব্য বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং বিভ্রান্তি তৈরি করছে।

গত শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এক-এগারোর ভয়াবহতা বিএনপির মতো আর কেউ ভোগ করেনি। তিনি আওয়ামী লীগকে ‘ভারতের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিএনপিকে এভাবে আক্রমণ না করতে সতর্ক করেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে সমালোচনা করা যাবে না কেন? এক-এগারোর পুনরাবৃত্তির ভয় দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা উচিত নয়।

নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানান, নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সরকারের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন। বিএনপি কেন অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তা স্পষ্ট করা উচিত। অন্যদিকে মির্জা ফখরুল বলেছেন, সরকার নিরপেক্ষ থাকলে তারা নির্বাচন পরিচালনা পর্যন্ত থাকতে পারবে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে বাংলাদেশের নতুন ভোটারদের ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়নি, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের মানুষ কোন ধরনের নির্বাচন চায়, সেটি না জেনে সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার নির্বাচন আয়োজনের অপেক্ষায় রয়েছে, তবে এখন দেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রক্রিয়াটি কেমন হবে। তারা কি ছোট পরিসরের সংস্কার কর্মসূচিতে যাবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চাইবে। যদি মানুষ দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, না—আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।

বিশ্লেষকের মত: চলমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি কি তাহলে প্যাঁচের আবর্তে পড়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ গতকাল কালবেলাকে বলেন, এখনই সেটি মনে হচ্ছে না। কারণ মাঠে-ময়দানে সেরকম কিছু দেখি না। রাজনীতিবিদরা নানা কারণে বিভিন্ন রকমের কথা বার্তা বলেন। সেটা অনেক সময় বাস্তবে রূপ নেয় না। এটি কেবলই তাদের যার যার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করার একটি ব্যাপার। তিনি বলেন, ‘সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন বা দাবি উঠতে পারে’ বিএনপি মহাসচিবের এমন প্রশ্ন প্রসঙ্গে ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ওই বাক্যে কিন্তু মির্জা ফখরুল বলেননি যে, সরকার নিরপেক্ষ না। তিনি বলেছেন ‘নিরপেক্ষ না থাকলে।’ কাজেই এটা নিয়ে হাইপ তোলা আমি মনে করি, দেশের রাজনীতির জন্য খুবই বিপজ্জনক। দেশের অনেক সমস্যা জটিল হয় শুধু প্রচারের কারণে। সুতরাং যারা দেশ সম্পর্কে চিন্তা ও দেশের মঙ্গল কামনা করেন, তারা চেষ্টা করবে বিরোধটা যাতে সংঘাতে রূপ না নেয়। রাজনীতিতে বিরোধ থাকবেই। এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। তবে বিএনপি যা বলছে, সেটি ঘুরিয়ে বলা যে, সরকারকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকে। বিএনপির দাবিকে আওয়ামী লীগের মতোই মনে করে সরকারের পক্ষে যা বলা হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে বরেণ্য এই বিশ্লেষক বলেন, নাহিদরা তো একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। স্বাভাবিক কারণেই তারা নিজেদের বিএনপির চেয়ে আলাদা ভাববে। তারা নানা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করবে। আজকের দিনে কেউ আওয়ামীমনা হয়ে গেছে; এটা দেখাতে পারলে তার রাজনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এ ব্যাপারে সবাই এমনভাবে কথাবার্তা বলবেন বা বলা উচিত যে, তিনি বা তারা আওয়ামীমনা হয়ে গেছেন।