Image description

জুলাই বিপ্লবের পর চট্টগ্রামের নগরভিত্তিক চারটি আসনের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। প্রার্থীর তৎপরতা, স্থানীয় স্তরের জোট-সমঝোতা, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ভোটব্যাংকের ওলটপালটসহ নানা সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এলাকাভেদে কারো জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কারো দলীয় অস্থিরতা সুযোগ করে দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের। ভোটারদের ভাষায়—এই চার আসনেই এবার লড়াই হবে লোকভিত্তিক, ব্র্যান্ডভিত্তিক এবং মাঠে কে কতটা সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল অবস্থান দেখাতে পারে, তার ওপর।

চট্টগ্রাম-৮, ৯, ১০ ও ১১ আসনে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় বিএনপি। কারণ, দলটি এবার এমন সব নেতাকে বিবেচনায় এনেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাজ করলেও মনোনয়ন পেয়েছেন বা পাচ্ছেন অন্য আসনে। স্থানীয়ভাবে যাদের এক আসনের মানুষ বলে ধরা হয়, তাদের হঠাৎ ভিন্ন আসনে পাঠানোর সিদ্ধান্তে দলটির নিচের স্তরে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দলটির এই ‘অতিকাঠামোগত সমীকরণ’ উল্টো দলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, চট্টগ্রামের নগর এলাকায় ভোটারের আচরণ মূলত ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ ও ‘পরিচিতিভিত্তিক’ এবং ‘মাঠে কে কত বছর ধরে আছেন’—এসবের ওপর নির্ভরশীল।

একই বিষয়ে ইঙ্গিত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ আমার দেশকে বলেন, বিএনপি যে মনোনয়নবিন্যাস করেছে, সেটি নেতা ও তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ তৈরি করেছে। দল যাদের বহু বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ‘মানুষের নেতা’ হিসেবে গড়ে তুলেছে, তাদের হঠাৎ সরিয়ে অন্যত্র পাঠালে সেই জনশক্তি কার্যকরভাবে মাঠে নামতে পারে না।

এদিকে বিএনপির অনেক নেতাই আশঙ্কা করছেন, এক আসনে দীর্ঘদিন ধরে যেসব নেতা রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়েছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন—তাদের হঠাৎ অন্য আসনে পাঠালে সেই নেটওয়ার্ক ভেঙে যেতে পারে। একইসঙ্গে নতুন স্থানে ভোটারদের মধ্যে বিশ্বাসও তৈরি করা কঠিন। এ অবস্থায় বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মন্তব্য, ‘মাঠে আমাদের পরিচিতি যেখানে, সেখানেই লড়াই করা সহজ। নতুন আসনে গেলে মানুষ চিনবে না।’

চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ বিএনপি নেতা একরামুল করিম আমার দেশকে বলেন, প্রথমেই বলে রাখি, দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমরা সেটিই মানি। তবে একটি কথা পরিষ্কার, দীর্ঘদিন যে নেতাকে একটি আসনের মানুষ প্রার্থী হিসেবে দেখে এসেছে, তাকে হঠাৎ অন্য আসনে পাঠালে ভোটের ওপর প্রভাব পড়বেই।

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও ও বোয়ালখালী)

এ আসনে নির্বাচনি পালাবদলের সবচেয়ে স্পষ্ট ছবিটা দেখা যাচ্ছে এখনই। পুরো এলাকায় ঘুরেফিরে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, তা হলো—জামায়াতের ডা. আবু নাসের মাঠ গরম করেছেন, আর বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ পড়েছেন দ্বিমুখী সংকটে। গত ফেব্রুয়ারিতেই জামায়াত এখানে প্রার্থী চূড়ান্ত করে। এরপর থেকেই ডা. আবু নাসের নিয়মিত চান্দগাঁও, মোহরা, বোয়ালখালী—এসব ওয়ার্ডের হাটবাজারে ঘনঘন প্রচার চালাচ্ছেন। স্থানীয় মসজিদ-মাদরাসা, পাড়া-মহল্লাভিত্তিক নেটওয়ার্ক তার সঙ্গে আগেভাগেই যুক্ত হয়েছে।

এখানে বিএনপির পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। কেন্দ্র থেকে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং শেষ মুহূর্তে এরশাদ উল্লাহকে মাঠে নামানো—সব মিলিয়ে বিএনপির তৃণমূলে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। অনেকেই এখনো ঠিক করতে পারছেন না, তারা পুরোপুরি নির্বাচনি মাঠে নামবেন কি না। নগর বিএনপির আহ্বায়ক ও প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ মাত্র তিনবার গণসংযোগ করেছেন এখানে। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর বায়েজিদের চালিতাতলী এলাকায় প্রচারের সময় গুলিতে নিহত হন তার সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসী সরওয়ার বাবলা। এরপর থেকে তিনি আর এলাকায় যাননি।

এনসিপির চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক জোবাইরুল হাসানকে প্রার্থী করা হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার পর তিনিও মাঠে নেমেছেন।

চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার চা-দোকানি রওশন মিয়া বলেন, নাসের সাহেবকে কয়েক মাস ধরে নিয়মিত দেখছি। মানুষের বাড়িতেও যাচ্ছেন, সমস্যার কথা শুনছেন। ভোটাররা এমন প্রার্থীই পছন্দ করেন।

বোয়ালখালী পৌরসভার কলেজছাত্রী রুমা আক্তারের ভাষায়, জামায়াত এখানে অনেক আগেই নেমেছে। নাসের ভাইয়ের গ্রহণযোগ্যতা আছে। বিএনপি এখনো ঠিকমতো দিক ঠিক করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি ও বাকলিয়া)

আসনটিকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র বলা হয়। এখানে আওয়ামী আমলে নির্বাচন করেছেন বর্তমান সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এলাকার মানুষ আসনটি মানেই ডা. শাহাদাত হিসেবে চিনত। কিন্তু হঠাৎ দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানকে চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে এনে প্রার্থী করায় মাঠে মিশ্র প্রভাব পড়েছে। অনেকটা জামায়াত প্রার্থীর চ্যালেঞ্জে পড়েছেন তিনি।

জামায়াত এখানে প্রার্থী করেছে ডা. ফজলুল হককে। চিকিৎসক হওয়ায় অনেক পরিবারভিত্তিক নেটওয়ার্ক রয়েছে তার। তিনি প্রকাশ্যে বড় শোডাউন করছেন ৫-৬ মাস ধরে। কারণ, গত ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত এই আসনে তাকে প্রার্থী করে। সামগ্রিকভাবে দলের উপস্থিতি, মাঠে আবু সুফিয়ানের অবস্থান এবং কেন্দ্রের রাজনীতিতে তার স্বীকৃতি—এ তিনটি কারণে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে আছেন।

২০০৫ সালে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থনে সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশ নেওয়া রিয়াজুল আনোয়ার চৌধুরীকে এই আসনে প্রার্থী করেছে এনসিপি। ছোট পরিসরে প্রচার শুরু করলেও নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারেননি তিনি।

চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং, হালিশহর ও পাহাড়তলী)

আসনটিতে গত কয়েক মাসে সবচেয়ে বেশি গতি এসেছে বিএনপি নেতা আমীর খসরুর তৎপরতায়। দলটির কেন্দ্রেও তার শক্ত অবস্থান আছে; তিনি বহু বছর ধরে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। তাকে নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে সমর্থকদের কর্মকাণ্ডও বেড়েছে, পাড়া-মহল্লায় অনেক উঠান বৈঠকও হচ্ছে।

ভোটাররা বলছেন, খসরু এ আসনে নতুন হলেও ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক, এ এলাকার রাজনৈতিক বলয়ে তার প্রভাব সব সময় থাকে। তরুণ ভোটার শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজনীতিতে চৌধুরী পরিবারের একটা পরিচিতি তো আছেই; কিন্তু খসরু সাহেব নিজেও কথা বলেন, শোনেন—এটা এখন বড় বিষয়।

জামায়াত এখানে অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালীকে দাঁড়িপাল্লার নমিনি করেছে। তিনি তরুণ নেতৃত্ব, সংগঠনে সক্রিয়। এখানে দলটির প্রচার বেশি হচ্ছে।

এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব সাগুফতা বুশরা মিশমাকে এই আসনের প্রার্থী করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে নগরজুড়ে তার পরিচিতি থাকলেও সংসদ নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেন—সে প্রশ্ন রয়ে গেছে

চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর ও পতেঙ্গা)

এ আসনে বিএনপির পরিস্থিতি এখনো ধোঁয়াশায় ঢাকা। প্রার্থী ঘোষণা না হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এলাকাটি বন্দরনির্ভর হওয়ায় এখানে বিশাল ব্যবসায়ী ভোটব্যাংক আছে; কিন্তু বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেই ভোটযোজনায়ও ভাটা পড়েছে। দলের ভেতরে অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি এখনো মাঠের বাস্তবতা নয়, বরং পরিবারভিত্তিক সমীকরণ ও অভ্যন্তরীণ লবিংকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেক নেতা সরাসরি বলছেন, প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় জামায়াত মাঠে তুলনামূলক এগিয়ে গেছে; কিন্তু বিএনপি কর্মীরা শুধু অপেক্ষা করছেন।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু চৌধুরী এলাকায় গণসংযোগ চালালেও দলের ভেতর ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’ নীতিকে কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছে তীব্র মতবিরোধ। নগর বিএনপির কয়েক নেতা বলেন, বিএনপির এই অনিশ্চয়তা মাঠের শক্তি কমাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না এলে কাউকে অনুসরণ করা যাবে না। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আমীর খসরু। বাবার গোছানো আসনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ইসরাফিল খসরু।

জামায়াত এ আসনে সবচেয়ে সুসংগঠিতভাবে মাঠে নেমেছে। কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে দেন যে, এ আসনে প্রার্থী শফিউল আলম। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকেই তিনি এলাকায় নিয়মিত মতবিনিময়, জনসংযোগ, পরিবারভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি এবং স্থানীয় মসজিদ, মাদরাসা, ওয়ার্ড পর্যায়ের সমর্থকদের সঙ্গে সমন্বয়ে ব্যস্ত। ফলে বিএনপি এখনো প্রার্থী সমীকরণে ব্যস্ত থাকলেও মাঠ দখলে অনেকটা এগিয়ে আছে জামায়াত।

জুলাই বিপ্লবের পর এ আসন থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রচার চালান দলটির যুগ্ম সমন্বয়কারী এরফানুল হক। তবে মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ আজাদ দোভাষ। যিনি জাতীয় পার্টির (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

পতেঙ্গার এক দোকানি মো. নুরুজ্জামান বলেন, শফিউল ভাইকে আমরা পাঁচ-ছয় মাস ধরে এলাকায় দেখছি। সব জায়গায় তার লোকজন আছে। বিএনপির প্রার্থী এখনো ঠিকমতো মাঠে নামেননি।

বন্দর থানার রামপুর এলাকার কলেজছাত্র রাকিবুল হাসান বলেন, জামায়াত আগেভাগে নেমে গেছে। তাদের ভোটার যারা, তারা ব্লক ধরে সংগঠিত। এ আসনে আমরা আমীর খসরুকেই চিনি। তিনি এখানে প্রার্থী হলে ভালো হতো।