আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে বিএনপির অন্তত অর্ধ শতাধিক আসনে মনোনয়ন নিয়ে তীব্র অন্তর্কোন্দল দেখা দিয়েছে। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর একাধিক আসনে মনোনয়নবঞ্চিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। অনেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন।
অভিযোগকারীদের দাবি, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয়, বয়োবৃদ্ধ, বিতর্কিত ও সুবিধাভোগী নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে ত্যাগী, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি বাড়ছে, যার রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে প্রতিপক্ষরা।
এই প্রেক্ষাপটে দুই ধাপে ঘোষিত ২৭২টি আসনের সম্ভাব্য একক প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকেছে বিএনপি। প্রথম ধাপে গতকাল বুধবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে দলটি। এতে নির্বাচনি প্রচারণার কৌশলসহ সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। মতবিনিময় সভায় বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, পরিবেশ, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় নেতাদের জন্য উন্নয়ন সেবা—এই আট বিষয়ে দলের পরিকল্পনা প্রার্থীদের জানানো হয়।
গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনে এবং ৪ ডিসেম্বর আরো ৩৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। পরে একটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের মাধ্যমে মোট ২৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তবে গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় বর্তমানে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ২৭১। বাকি ২৯টি আসনে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও নিজেদের প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে প্রথম দফা সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করে প্রার্থী বদলের দাবি জানিয়ে আসছে। বঞ্চিতদের অভিযোগ, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নব্য, হাইব্রিড, বয়োবৃদ্ধ ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স, শারীরিক অক্ষমতা কিংবা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। কোথাও কোথাও চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগও আনা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন আইনুল হক। তবে তার বিরুদ্ধে এলাকায় নানা অভিযোগ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। তাদের অভিযোগ, দলের দুঃসময়ে রাজপথে সক্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনুল হকের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-১২ আসনে মনোনীত প্রার্থী এনামুল হক এনামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দেন ৬৮০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা। তারা এনামকে চাঁদাবাজ ও বিতর্কিত উল্লেখ করে বলেন, তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ত্রাস সৃষ্টি, মাদকের রাজত্ব কায়েম, চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্য এবং বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের ঘনিষ্ঠতার কারণে পটিয়া পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়নসহ পুরো এলাকায় তার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি রয়েছে।
পটিয়া উপজেলা বিএনপির নেতা মিজবাহুল চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদের মতো ত্যাগী নেতারা এ আসনে মনোনয়নের দাবিদার ছিলেন।
এদিকে গত ২৩ নভেম্বর দিনাজপুর-২ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী সাদিক রিয়াজ পিনাক চৌধুরীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন একই আসনের তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী—জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ কালু এবং প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম। তারা অভিযোগ করেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পিনাক চৌধুরী ব্যবসায়িক সুবিধা ভোগ করেছেন এবং ২০২৩ সালে একমাত্র মামলায় জামিন পেয়ে আর কারাবরণ করতে হয়নি। আওয়ামী লীগের নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সুপারিশে তিনি মুক্তি পান বলেও অভিযোগ করা হয়। এর ফলস্বরূপ তিনি খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার একটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন।
অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন মিল-কারখানা থেকে চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিজ দলীয় কর্মীকে হত্যাচেষ্টা ও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় বিএনপি নেতা ইসমাইল চৌধুরী বলেন, বিরল উপজেলায় ভোটার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও পিনাক চৌধুরীর বাড়ি বোচাগঞ্জ উপজেলায় হওয়ায় জামায়াতের প্রার্থী সুবিধা পেতে পারেন। তার মতে, ত্যাগী নেতা মোজাহারুল ইসলাম কিংবা বজলুর রশিদ কালুকে মনোনয়ন দিলে ভোটের হিসাব বদলে যেতে পারে।
গত ২৯ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে দুই উপজেলা বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, সম্ভাব্য প্রার্থী মুশফিকুর রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর কানাডা প্রবাসী ছিলেন। নব্বই বছরের বয়োবৃদ্ধ এ নেতা অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাচল করতে পারেন না। এ অবস্থায় তাকে বহাল রাখলে নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে। আখাউড়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকতার খান জানান, মাঠে সক্রিয় তরুণ নেতা কবীর আহমেদ ভূইয়াকে বঞ্চিত করায় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী মেহেদী হাসান রুমীকে পরিবর্তনের দাবিতে দুই উপজেলা ও পৌর বিএনপির নেতারা লিখিত অভিযোগ করেন। তারা বলেন, বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ হওয়ায় রুমীর পক্ষে নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। খোকসা উপজেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, দীর্ঘদিন মাঠে থাকা তরুণ, মার্জিত আর শিক্ষিত নেতা শেখ সাদীকে বাদ দিয়ে একজন বয়োবৃদ্ধকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
জামালপুর-২ আসনে সুলতান মাহমুদ বাবুকে মনোনয়ন দেওয়ায় অসন্তোষ জানিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলেন, তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থি ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। অপরদিকে, এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী এএসএম আব্দুল হালিম শিক্ষিত, ত্যাগী ও আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় নেতা হিসেবে এলাকায় সমধিক সমাদৃত। এই আসনের ইসলামপুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে সর্বোচ্চ ভোট রয়েছে। সেখানেই তার বাড়ি হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতে তিনি এগিয়ে থাকবেন বলে দাবি করেন নেতাকর্মীরা।
চট্টগ্রাম-১৩ আসনে ৮০ বছর বয়সি সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজামের মনোনয়ন নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস বলেন, দলের দুঃসময়ে যারা রাজপথে ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই প্রার্থী দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন অভিযোগের কারণে নেত্রকোনা সংসদীয় আসন নেত্রকোনা-৫ আসনে ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে নেতাকর্মীদের। এই আসনে প্রার্থী পরিবর্তন না হলে শুধু সাধারণ ভোটাররা বিগড়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ইকরামুল আলম।
এদিকে গত ১৯ নভেম্বর তারেক রহমান বরাবর এক চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন অপর সাত মনোনয়নপ্রত্যাশী। এতে বলা হয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী মান্নান ও তার ছেলে এলাকায় চাঁদাবাজি, দখল, নদীপথে চাঁদাবাজি, মামলা-মোকদ্দমা, বালুমহল দখলসহ নানান অপকর্মে জড়িয়েছেন। এছাড়া দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটারদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন, এসব বিতর্কিত প্রার্থী বহাল থাকলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। এতে সম্ভাব্য বিজয়ী আসন হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, কয়েক দফা মাঠ জরিপ, সাংগঠনিক নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে এবারের সম্ভ্যাব্য প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এটাই চূড়ান্ত নয়। এই তালিকায় প্রয়োজন অনুসারে কিছু কিছু পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলের কোন্দলকে মেনে নেওয়া হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে যেতে হবে। এজন্য দল প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।