Image description

১৭ বছরের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাম সামনে রেখে দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গেলেও দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তার ফেরা অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে এমনটা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই থাকুন, কমপক্ষে ২৫ বছর ধরে রাজনীতি ও আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এই রাজনীতিকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে নানা রকম সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত তার ফেরা নির্বাচনের হিসাবনিকাশে নতুন মাত্রা যোগ করবে এমনটা মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যক্তিগত একটি ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তন। এতে শুধু যে দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে, তাই নয়, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কার ছায়া রয়েছে, সেটিও কেটে যাবে। নির্বাচন সামনে রেখে জোটের যে রাজনীতি, তাতে নতুন সমীকরণ দেখা যাবে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে।

১৯৯১ সালের আগে থেকে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় রাজনীতি আবর্তিত হয়। তিনি মারাত্মক অসুস্থ, হাসপাতালে শয্যাশায়ী। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পটপরিবর্তনের পর থেকে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজনীতিতে পরবর্তী প্রজন্মের উত্থানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রেক্ষাপটে দেশে এসে সরাসরি তার রাজনীতির হাল ধরা নতুন সুযোগের দুয়ার খুলে দিতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ্ দেশ রূপান্তরকে গতকাল সোমবার বলেন, ‘সবমিলিয়ে তার জন্য দেশে আসাটা রাজনৈতিক জীবনের জন্য নতুন সুযোগের দুয়ার খুলে দেবে।’

মাহবুব উল্লাহ্ বলেন, ‘আজকাল ইন্টারনেটের যুগে দলের মনোনয়নসহ সব ধরনের কাজই তিনি সঠিক সময়ে করতে পারছেন। এখন তিনি দেশে সশরীরে আসবেন। রাজনীতি এমন জিনিস, শুধু ভার্চুয়ালি মুখের কথা শোনা গেলে ঘনিষ্ঠ রাজনীতির সৃষ্টি হয় না। এই ঘনিষ্ঠ রাজনীতি সৃষ্টি করতে হলে জনগণের কাছে দৈহিক উপস্থিতি দরকার। সেদিক থেকে তিনি দেশে ফিরলে সেই ঘনিষ্ঠতা বাড়বে।’

অর্থনীতির এই অধ্যাপক মনে করেন, তারেক রহমান যদি তার ‘দরজা খোলা রাখেন’ তাহলে কর্মী, সমর্থক, সমালোচকদের কথা শোনার ও জানার সুযোগ তৈরি হবে। তাতে তার দলের রাজনীতি সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারবেন। তিনি কর্মীদের আরও কাছে আসার সুযোগ পাবেন। এটা করতে পারলে বিএনপিকে আবার নবরূপ দিতে পারবেন। সেই সুযোগ দিতে না পারলে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এ কথাগুলো প্রযোজ্য।

মাহবুব উল্লাহ্্ বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক সময় কর্মী-সমর্থকদের দূরে সরিয়ে দেয়। এই অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে হবে।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ফেরার তারিখ জানান। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া এ ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বিএনপির অভিযোগ, বিগত স্বৈরাচারী সরকার তাকে স্থায়ীভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে ডজন ডজন রাজনৈতিক মামলা দেয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তনের পর আদালতের রায়ে তারেক রহমান সব মামলায় বেকসুর খালাস পান। এখন তিনি কোনো আইনি জটিলতা ছাড়াই একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে দেশে ফিরছেন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের মতে, এই আইনি বিজয় তাকে নির্বাচনের মাঠে নৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগবিহীন বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে বিএনপির জন্য একটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। গত এক বছর মাঠপর্যায়ে বিএনপি সক্রিয় থাকলেও শীর্ষ নেতৃত্বের সশরীরে অনুপস্থিতি দলটির জন্য একটি বড় দুর্বলতা ছিল। তার ফেরার ঘোষণা এমন একসময়ে এলো, যখন তাদেরই সাবেক মিত্র জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির মাঠে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার চেষ্টা করছে। জামায়াত নিজেদের বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের ফেরা জামায়াতের হিসাব পাল্টে দেবে। তার উপস্থিতি বিএনপির তৃণমূলকর্মীদের মনোবল বাড়িয়ে জামায়াতের একক মাথাচাড়া দেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এবারের নির্বাচন আর ‘আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি’ লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না। নির্বাচন হতে যাচ্ছে মূলত বিএনপি বনাম জামায়াত এবং অন্যান্য ছোট দলের মধ্যে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা জামায়াতের শক্তি প্রদর্শনের কৌশলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তারেক রহমান যেদিন দেশে ফিরবেন, সেদিন নির্বাচনের সবকিছু প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। তিনি দেশে এলে বিএনপির নির্বাচনের কাজ অর্ধেক শেষ হয়ে যাবে।’

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ঝুঁকি আছে, এটা জেনেই সাহসিকতার সঙ্গে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তার রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে দলের তৃণমূলপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবলে। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন, মামলা ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকা কর্মীদের জন্য এটি হবে এক ধরনের মানসিক পুনর্জাগরণ।

দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরায় ভোটের মাঠের হিসাব পাল্টে যাবে। ভোটে বিএনপির গণজোয়ার সৃষ্টি হবে।’

নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ওপর তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের প্রভাব পড়বে এমনটাও মনে করেন অনেকে। এতদিন তারা তাকে শুনেছেন মূলত বিতর্ক ও অপপ্রচারের মধ্যে। এখন সরাসরি তার বক্তব্য শোনা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার সুযোগ পাবেন তরুণরা। সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা সাধারণত সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারেক রহমানের সরাসরি উপস্থিতি সেই নীরব ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারে।

দেশে ফেরার আগেই ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ উপস্থাপন তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ এমনটাও মনে করেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার রূপরেখা এই পরিকল্পনার অন্তর্গত।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় তারেক রহমানকে নানা কিছু মোকাবিলা করতে হবে। তার মা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ১০ দিন পর কী হবে, সেটি কেউ বলতে পারবে না। নির্বাচন সামনে। আবার ওসমান হাদির মতো ঘটনাও বিশৃঙ্খলার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সব মিলিয়ে তারেক রহমানের এ সময় আসা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলাটা বড় চ্যালেঞ্জিং হবে।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এই মুহূর্তে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের একটা শূন্যতা আছে। তারেক রহমানের ফেরার মধ্য দিয়ে এ শূন্যতা খানিকটা পূরণ হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, নানা প্রশ্নে মতভিন্নতা থাকলেও নির্বাচন, গণভোট, গণতন্ত্র উত্তরণের এ যাত্রায় সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের সংস্কৃতি তৈরির যে আশাবাদ, তা তিনি ধারণ করতে পারলে, একটা রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন হবে।