Image description

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার একদিন পরই ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় আগ্রাসন এবং আওয়ামী লীগের দেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অন্যতম সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত হাদি। হামলার পদ্ধতির কারণে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র এটিকে ভারত ও তাদের মদতপুষ্ট চক্রের সুদূরপ্রসারী হুমকির বাস্তবায়ন হিসেবে দেখছে। এই পূর্বপরিকল্পিত হত্যাচেষ্টার নেপথ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে জোর সন্দেহ করছে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী।

তদন্তসংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি অনুযায়ী, হাদির ওপর এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং বিদেশি চক্রান্তের অংশ। পলাতক ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা এবং ভারতের ‘দাদাগিরি’ বন্ধে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে দিল্লি ক্ষুব্ধ। হাদি ভারতীয় আগ্রাসন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সব দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের অন্যতম ‘আইকন’। ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর আখ্যা দিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি ভাঙা ও শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে তিনি ছিলেন সরব। এ কারণে তিনি ভারত ও তাদের দেশীয় মদতদাতা চক্রের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন।

ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজ ও গুলির শেল বিশ্লেষণ করে নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, হামলাটি কোনো সাধারণ গুণ্ডা বাহিনীর কাজ নয়। এটি অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও পেশাদার একটি কিলার টিমের কাজ, যারা টার্গেট সিলেকশন থেকে শুরু করে হামলা চালানো এবং মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় দক্ষ। তদন্তকারীদের প্রাথমিক ভাষ্য, এই পেশাদার হিটম্যানদের প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক সহায়তা ও নির্দেশনা দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং)। বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলা তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। যার অংশ হিসেবে হাদির মতো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে সরিয়ে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে কিছু সংশ্লিষ্ট তথ্যও পাচ্ছেন তারা।

অনুপ্রবেশ, আন্ডারওয়ার্ল্ড ও অস্থিতিশীলতার ব্লুপ্রিন্ট

গোয়েন্দা তথ্যে আরো জানা গেছে, দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে নির্বাচনকে বানচালের জন্য বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত কয়েক মাসে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রায় ৮০ জনের মতো প্রশিক্ষিত আততায়ী দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে বলে কয়েকদিন ধরে বেশ জোরেশোরে আলোচনা চলছিল। যাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের মতো ব্যক্তিরা রয়েছে।

এই অনুপ্রবেশকারীরা দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড ও চরমপন্থি গ্রুপগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নিরাপত্তা ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মিলিয়ে দেখছে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কারাবন্দি সুব্রত বাইন, জামিনে থাকা পিচ্চি হেলাল এবং চরমপন্থি গ্রুপ গণমুক্তি ফৌজের প্রধান মুকুলের মধ্যে টেলিফোনে কনফারেন্সের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা ঘটানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। সুব্রত বাইন কারাগার থেকে নেপালে পলাতক বিডিআর মামলার আসামি লেদার লিটনসহ অন্যান্য শীর্ষ অপরাধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এই চক্রের মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনকে ব্যাহত করে দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। হাদির ওপর হামলা এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কৌশলগত প্রথম ধাপ বলে উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে।

সংশয়জনক গতিবিধি

হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিছু রহস্যময় গতিবিধি তদন্তকারীদের সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, হামলার আগে দুই তরুণ রহস্যজনকভাবে হাদির আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, এই দুই যুবক কিলার গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছে।

অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি অডিও কনভার্সেশন তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। মাত্র দুদিন আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে লীগের এক সন্ত্রাসীর কথোপকথন ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে ওই সন্ত্রাসী ‘জুলাই বীরদের খুন’ করার কথা বললে শেখ হাসিনা তাকে ‘পারলে করে দেখাও’ বলে উসকে দেন। হাদির সমর্থক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তার ওপর এই হামলা শেখ হাসিনার সেই উসকানিমূলক কথারই বাস্তবায়ন। হামলার পেছনে শেখ হাসিনাই হুকুমের আসামি হতে পারেন। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির পরিচয় দ্রুত চিহ্নিত করার দাবি উঠেছে বেশ জোরেশোরেই।

এছাড়াও, হামলার আগে হাদির নিরাপত্তার কথা বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ব্যক্তি দাবি করেছিলেন, তিনি র‌্যাবের সাবেক সদস্য এবং হাদির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু হামলার দিন সেই ব্যক্তির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে জানা গেছে, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার সময়ও এই একই ব্যক্তিকে সক্রিয় দেখা গিয়েছিল। তদন্তের স্বার্থে এই রহস্যময় ব্যক্তির গতিবিধি এখন নিবিড় নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।

 

হত্যার হুমকি

গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রায় এক মাস আগে, গত ১৪ নভেম্বর, শরীফ ওসমান হাদি তার ফেসবুক পোস্টে অন্তত ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে পরিবারসহ তাকে হত্যা, তার স্ত্রীকে ধর্ষণ ও বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়ার হুমকির কথা জানিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, ‘এক হাদিকে হত্যা করা হলে তাওহীদের এই জমিনে আল্লাহ লক্ষ হাদি তৈরি করে দেবেন। স্বাধীনতার এই ক্রুদ্ধ স্বরকে কোনোদিন রুদ্ধ করা যাবে না।’

বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সম্পূর্ণ রূপে অকার্যকর ও দেশকে চরম অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। হাদি হত্যাচেষ্টা এই বৃহত্তর পরিকল্পনারই প্রথম ধাপ মাত্র। এই গোষ্ঠী আন্ডারওয়ার্ল্ড, চরমপন্থি সংগঠন এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার অর্থ ও সমর্থনে শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রার্থী, কেন্দ্রীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে একের পর এক হামলা চালিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। তবে গোয়েন্দা তথ্য আগাম জানিয়ে দেওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে এবং এই নেটওয়ার্কের মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে কঠোর অপারেশন শুরু করেছে।