Image description

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘ ১৫ বছর পর ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। বিগত দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে ঘাম ঝরিয়েছে বিএনপি এবং তাদের সমমনা মিত্র দলগুলো। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মামলা, হামলা ও নির্যাতন সহ্য করে যে ‘যুগপৎ আন্দোলন’ গড়ে উঠেছিল, নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে সেই ঐক্যের সুরে এখন ভিন্ন সুর বাজছে। মিত্রদের পক্ষ থেকে এরমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজপথের সেই পুরোনো মিত্রদের চেয়ে দলীয় স্বার্থকেই যেন বড় করে দেখছে বিএনপি।

ইতোমধ্যেই বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭২টি আসনে এককভাবে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলীয় সূত্র মতে, শেষ পর্যন্ত মিত্রদের জন্য সর্বোচ্চ ১৩টি আসন ছাড়া হতে পারে। এতেই ক্ষোভ, হতাশা ও চরম অসন্তোষ দানা বেঁধেছে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র দলগুলোর মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের রাজনীতির এই জটিল সমীকরণে বিএনপি কি তার মিত্রদের তুষ্ট করতে পারবে, নাকি নির্বাচনের আগেই ফাটল ধরবে দীর্ঘদিনের এই মিত্রতায়?

গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিএনপি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাতে তাদের সঙ্গে ছিল গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, বিজেপি, গণঅধিকার পরিষদ, এনডিএম, চারদলীয় বাম জোট এবং লেবার পার্টির মতো প্রায় ৫৭টি দল ও সংগঠন। এদের অধিকাংশই নিবন্ধিত না হলেও রাজপথের আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল গিুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গত দুই বছরে সরকার পতনের আন্দোলনে এই দলগুলো পুলিশের লাঠিপেটা ও জেল-জুলুম সহ্য করে বিএনপির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল বলে রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

স্বাভাবিকভাবে তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মিত্র দলগুলোর প্রত্যাশা ছিল অনেক উঁচুতে। তারা আশা করেছিল, বিএনপি তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করে সম্মানজনক সংখ্যক আসনে ছাড় দেবে। গত অক্টোবরে এসব দলকে প্রার্থী তালিকা দিতে বলেছিল বিএনপি। দলগুলোর তালিকা খতিয়ে দেখা যায়, বিএনপির কাছে এলডিপি ৪০টি আসন, ১২ দলীয় জোট ২১টি, গণফোরাম ১৫টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ৯টি, বিজেপি ৫টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ৬টি এবং এনডিএম ১০টি আসন চেয়েছিল। সব মিলিয়ে মিত্রদের চাহিদার তালিকা ছিল দীর্ঘ। কিন্তু বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী তালিকা সেই প্রত্যাশায় যেন পানি ঢেলে দিয়েছে।

গত ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রথম দফায় ২৩৭টি আসনে দলীয় ‘সম্ভাব্য’ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। এই তালিকা প্রকাশের পরই মিত্রদের মধ্যে অস্বস্তি শুরু হয়। তবে দলটির হাইকমান্ড থেকে তখন বলা হয়েছিল, এই তালিকা চূড়ান্ত নয়, সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। একদিনের মাথায় দলীয় কারণে মাদারীপুর-১ আসনের মনোনয়ন স্থগিত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে গত ৪ ডিসেম্বর দলের পক্ষ থেকে আরও ৩৬টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ দুই ধাপে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭২টিতেই ধানের শীষের প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছে বিএনপি। বাকি রাখা হয়েছে মাত্র ২৮টি আসন।

বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র ও নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বাকি থাকা ২৮টি আসনের মধ্যে মিত্রদের জন্য প্রাথমিকভাবে যাদের জন্য আসন ছাড়া হতে পারে, সেই তালিকায় আছেন- গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ (ঢাকা-১৭), জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার (পিরোজপুর-১), এনডিএমের ববি হাজ্জাজ (ঢাকা-১৩), গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর (পটুয়াখালী-৩) এবং রাশেদ খান (ঝিনাইদহ-২), নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-২), বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম (লক্ষ্মীপুর-১), জেএসডির আ স ম আবদুর রব অসুস্থ থাকায় তার স্ত্রী তানিয়া রব (লক্ষ্মীপুর-৪), এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক (চট্টগ্রাম-১৪) এবং দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ (কুমিল্লা-৭), জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের উবায়দুল্লাহ ফারুক (সিলেট-৫) এবং মনির হোসেন কাসেমী (নারায়ণগঞ্জ-৪)। এছাড়া জমিয়ত মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর জন্য নীলফামারী-১ এবং নায়েবে আমির জুনায়েদ আল হাবিবের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন খালি রাখা হয়েছে। এই দুটি আসন নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।

এদিকে দ্বিতীয় দফায় দলীয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই বিএনপির সঙ্গে দুই দশকের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতি টেনেছেন বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। গত শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে দলটি। এছাড়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নাগরিক ঐক্য ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। আসন না পাওয়ার শঙ্কায় ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ আগেই বিএনপির মিত্রজোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ ত্যাগ করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ ১২০ আসনে নিজেদের প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছিল, কিন্তু বিএনপি তাদের মাত্র তিনটি আসনের নিশ্চয়তা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এতে জোটের অভ্যন্তরে হতাশা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি এখনই এই ক্ষোভ প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে আরও কয়েকটি দল জোট ছাড়তে পারে, যা ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তারা মনে করছেন।

একইভাবে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদাকে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলেও সেখানে বিএনপি দলীয় প্রার্থী দিয়েছে। এছাড়া নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ২০১৮ সালে জোটের প্রার্থী হলেও এবার সেখানে বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। কুষ্টিয়া-২, মৌলভীবাজার-২ ও যশোর-৫ আসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতেও শরিকদের আশা ভঙ্গ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, “প্রার্থী ঘোষণার আগে যে আলোচনার দরকার ছিল, বিএনপি তা করেনি। যে আসনে আমি নির্বাচন করতে চেয়েছি, সেখানে প্রার্থী দেওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনটুকুও বিএনপি মনে করেনি।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এবার খুব সতর্ক ও কৌশলী অবস্থানে রয়েছে। তারা মনে করছে, বিগত নির্বাচনগুলোতে জোটের খাতিরে এমন অনেক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল যাদের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। এবার আর সেই ঝুঁকি নিতে চায় না দলটি। কিন্তু আলোচনা ছাড়াই জোটের শীর্ষ নেতাদের আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করায় মিত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এবারের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ও কৌশলী অবস্থান তৈরি করেছে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও। আরপিও- এর নতুন বিধান এবারের নির্বাচনে জোটের সমীকরণকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে। অতীতে জোটের শরিক দলগুলোর সুযোগ ছিল জোটপ্রধানের প্রতীক ব্যবহার করে ভোটে অংশ নেওয়ার। কিন্তু সংশোধিত নিয়মে নিবন্ধিত দলগুলো জোটবদ্ধ হলেও ব্যালট পেপারে তাদের লড়তে হবে নিজস্ব প্রতীকেই। আইনি এই বাধ্যবাধকতার কারণে ভোটের মাঠে প্রতীকের বিষয়টি এবার বিএনপির কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ভোটের মাঠে শরিক দলগুলোর নিজস্ব প্রতীক ভোটারদের কাছে পরিচিত করানো এবং সেই প্রতীকে ধানের শীষের ভোটারদের ভোট দেওয়ানো অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ধানের শীষের পক্ষে নেতাকর্মীদের যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নামানো সম্ভব, অন্য দলের অচেনা প্রতীকের পক্ষে সেভাবে নামানো মাঠ পর্যায়ে প্রায় অসম্ভব। এই আইনি মারপ্যাঁচ মিত্রদের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। মিত্রদের আসন ছাড়ার ক্ষেত্রে তাই বিএনপি এবার সংখ্যার চেয়ে প্রার্থীর ‘জয়ের সক্ষমতা’কেই মানদণ্ড হিসেবে ধরছে। দলটির নীতিনির্ধারকদের মনে করছেন- শরিকদের কেবল মনোনয়ন দেওয়াই শেষ কথা নয়, তাদের বিজয় নিশ্চিত করে সংসদে আনাই মূল লক্ষ্য।

মিত্রদের সামলানোর জন্য বিএনপি এবার এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করছে। যেসব শরিক নেতার এলাকায় নিজস্ব ভোটব্যাংক কম বা দলীয় প্রতীকে জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাদের বিএনপি সরাসরি দলে যোগ দিয়ে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে বিএনপি মিত্রদের সংসদে আনতে চায় ঠিকই, কিন্তু তা নিজেদের দলীয় কাঠামোর ভেতরে রেখে। ইতোমধ্যে ১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ বিএলডিপির প্রধান নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন এবং তাকে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) নেতা ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন এবং তার ক্ষেত্রেও একই পন্থা অনুসরণ করা হতে পারে বলে জোর আলোচনা রয়েছে।

যেসব শরিকদের আসন ছাড় দেওয়া সম্ভব না, তাদের জন্য বিএনপি একটি বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে বলেও দলের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, শরিকদের মধ্যে যারা জ্যেষ্ঠ নেতা আছেন, যারা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভোটের মাঠে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাদের জন্য জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব দেওয়ার চিন্তা করছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিএনপি তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা চালু করা হবে। সেখানে এইসব ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। তবে মিত্র দলগুলোর নেতারা নগদ প্রাপ্তি অর্থাৎ সংসদীয় আসন নিশ্চিত করতেই বেশি আগ্রহী। ভবিষ্যতের এই প্রতিশ্রুতি তাদের বর্তমান অসন্তোষ কতটা কমাতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

আসন্ন নির্বাচনের আগে হাতে সময় আছে মাত্র দুই মাস। অথচ আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনো সুরাহা না করায় শরিক দলগুলোর অভিযোগ, বিএনপি ইচ্ছা করেই বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে যাতে শেষ সময়ে এসে শরিকরা আর দরকষাকষি করতে না পারে। এই দীর্ঘসূত্রতা মিত্রদের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে প্রার্থী ঘোষণা করলে বা আসন পেলে মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালানো এবং ভোটারদের কাছে পৌঁছানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানাচ্ছেন তারা। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে শরিকদের। তবে মিত্রদের ক্ষোভের মাঝেই আশার আলো দেখছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি মনে করেন, এখনো আলোচনার সুযোগ ও জায়গা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। অন্যদিকে, সংকট নিরসনে আশার বাণী শোনাচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারাও। 

দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, “নির্বাচনী জোট ও আসন বণ্টন নিয়ে তো আলোচনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আলোচনা চলছে, তা অব্যাহতও থাকবে।”

নির্বাচনের আগে জোট-প্রার্থী ও মনোনয়ন নিয়ে এমন টানাপোড়েন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও। বাংলানিউজকে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের কমিটি এসব সমস্যা সমাধানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সব ভুল বোঝাবুঝি অচিরেই কেটে যাবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই বিএনপি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শরিকদের কাঙ্ক্ষিত আসনগুলো যেখানে বিএনপি ইতোমধ্যে তাদের দলীয় প্রার্থীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দু-একটিতে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার চিন্তাভাবনা করছে দলটি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যৌক্তিকভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জোটের ঐক্য ধরে রাখতে চায় দলটি। তাই মিত্রদের মধ্যে যাদেরকে শেষ পর্যন্ত আসন ছাড়া সম্ভব হবে না, সরকার গঠন করলে তাদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ মূল্যায়ন করার ইচ্ছাপোষণ করেছে দলের হাইকমান্ড। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়।

মিত্রদের এই ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমনে এবং সৃষ্ট দূরত্ব ঘোচাতে বিএনপি বুধবার (১০ ডিসেম্বর) থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করছে বলেও জানা গেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন লিয়াজোঁ কমিটিকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে বসে এই বিষয়টির সমাধান করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর অংশ হিসেবে ১২ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করবে বিএনপি। এছাড়া দ্রুততম সময়ে গণতন্ত্র মঞ্চ ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গেও তাদের বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য যেমন অগ্নিপরীক্ষা, তেমনই তাদের মিত্রদের জন্যও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। গত ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে, ক্ষমতার দ্বারে এসে তাদের মধ্যে এই টানাপোড়েন শুভলক্ষণ নয় বলে মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হলেও, রাজনীতির মাঠে মিত্রদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। লেবার পার্টির মতো পুরোনো মিত্রের বিদায় এবং নুর বা মান্নার মতো নেতাদের অসন্তোষ বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপিকে এখন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ‘উইনেবল ক্যান্ডিডেট’ বা জয়ের সম্ভাবনাময় প্রার্থী এবং ‘জোটের ঐক্য’- এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যদি বিএনপি তাদের দীর্ঘদিনের মিত্রদের সম্মানজনকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা কেবল জোটেই ফাটল ধরাবে না, বরং নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নেও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।