২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণার পর দিন দশেক পার হলেও মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। এতে জোটের শরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। শরিক দলের অভিযোগ— যেসব আসনে তাদের নজর রয়েছে, সেখানে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতিমধ্যে মাঠে নেমে প্রচারণা শুরু করেছেন, যা জোটের সমন্বয় নষ্ট করছে।
বিএনপি বলছে, শরিকদের দাবিগুলো পর্যালোচনায় সময় লাগছে। তবে শরিকদের আশঙ্কা— আসন সমঝোতায় দেরি হলে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে নামতে পারেন, যা জোটের ঐক্যকে দুর্বল করবে।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি ইতিমধ্যে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে, দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছাতে।
৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে (এর মধ্যে মাদারীপুর-১ আসন স্থগিত) সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। এই ঘোষণার পরপরই বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচারণায় মাঠে নেমে পড়েন। ফলে সারা দেশে নির্বাচনি আবহ তৈরি হয়। এর ফলে জোট শরিকরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আসন সমঝোতার বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার থেকে মিত্র রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। ধারাবাহিক বৈঠকের প্রথম দিন রাতে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠক হয়। আজ ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। এতে দ্রুত আসন ঘোষণার পাশাপাশি বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকার নিশ্চয়তা চাইবে মিত্ররা।
এদিকে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে আগামী নির্বাচন করতে চাইছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। তবে তারা যতগুলো আসন চাইছে বিএনপি তা ছাড়তে রাজি হচ্ছে না। এ নিয়ে দুদলের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে বলে জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর দাবি, ৬৩টি ফাঁকা থাকলেও এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ আসন মিত্র রাজনৈতিক দল ও জোটকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।
সোমবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও মিত্রদের আসন ছাড় নিয়ে আলোচনা হয়। এতে দীর্ঘদিনের মিত্রদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এরই অংশ হিসাবে বুধবার থেকে বৈঠক শুরু করে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, শরিকদের আসন নিয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যারা শরিকদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন, তাদের নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বসবেন।
মিত্র অন্তত দশটি দলের শীর্ষ নেতারা যুগান্তরকে জানান, তাদের আসনে প্রায় প্রতিদিনই বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কর্মসূচি পালন করছেন, শোডাউন ও গণসংযোগ করছে। সেজন্য তারা সেভাবে (মিত্র দলের প্রার্থী) মাঠে নামতে পারছেন না। তাদের মতে, বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গে একই আসনে মাঠে নামলে একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে। তাছাড়া এতে প্রতিটি আসনে সাধারণ ভোটাররাও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বে বলেও তারা মনে করেন।
শরিক দলের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে অবহিত করে দ্রুত এর সমাধান করতে একাধিকবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
মিত্রদের মধ্যে নিবন্ধিত কয়েকটি দলের নেতারা জানান, আরপিও অনুযায়ী জোটে থাকলেও নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এখন তাদের আসনে বিএনপির প্রার্থীরা ধানের শীষের পক্ষের প্রচারণা চালাচ্ছেন। আসন সমঝোতা হলেও শরিকদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিএনপির প্রার্থীরা যেভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, তাতে সাধারণ ভোটাররা ধানের শীষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। পরে আসন ছাড় দেওয়া হলেও আবার অন্য প্রতীকের পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। কারণ এখন একেকটি দিন তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই আসন সমঝোতার বিষয়টি তারা দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা শরিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রার্থিতার বিষয়টি নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। বিগত আন্দোলনে শরিক দলগুলোর নেতাদের ভূমিকা, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, জনপ্রিয়তা, ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে তাদের প্রয়োজনীয়তাসহ বিভিন্ন বিষয় প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সে হিসাবে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জন্য অন্তত ২৩টি আসন ছাড়ের কথা ভাবা হচ্ছে। অবশ্য সেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নেই। এ দুই দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে ৪০টির মতো আসনে ছাড় দেবে বিএনপি।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা যুগান্তরকে জানান, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের জন্য প্রাথমিকভাবে তারা ২২টি আসন বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের পাঁচটি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে পাঁচটি, ১২ দলীয় জোটকে তিনটি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (বিজেপি) একটি, গণঅধিকার পরিষদকে দুটি ও এলডিপিকে দুটি আসন দেওয়া হতে পারে। এছাড়া জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও গণফোরামকে একটি করে আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। তাদের কাউকে কাউকে প্রার্থিতার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া হলেও এখনো নাম ঘোষণা করা হয়নি। আবার এ তালিকায় শীর্ষ নেতা কেউ বাদ পড়লে তাকে উচ্চকক্ষে নেওয়ার কথাও বিএনপির পক্ষ থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি তো এখন পর্যন্ত আমাদের (গণতন্ত্র মঞ্চ) একজনকেও বলেনি যে আপনারা নমিনেশন পাবেন। তারা কাকে কোথায় ভাবছে, তার প্রস্তাব পেলে আমরা এ বিষয়ে কথা বলতে পারতাম। এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই জানি না।’
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, ৬৩ আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করেনি বিএনপি। সব হয়তো শরিকদের দেবে না। যেসব আসনে ছাড় দেবে সেগুলো দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা উচিত।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, বুধবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। আসন ছাড়ের বিষয়টি বিএনপিও সুরাহা করতে চাইছে। আশা করছি শিগগিরই হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে আসন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি : এদিকে বিএনপির এক সময়ের জোটসঙ্গী কয়েকটি দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিলেও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম যায়নি। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেই নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে। এজন্য বিএনপির কাছে কিছু আসন চেয়ে একটি প্রার্থী তালিকা দিয়েছে জমিয়ত। সেই তালিকায় দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আমির উবায়দুল্লাহ ফারুক (সিলেট-৫), মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী (নীলফামারী-১), কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী (সিলেট-৪), জুনায়েদ আল হাবিব (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২), মনির হোসেন কাসেমী (নারায়ণগঞ্জ-৪), মোখলেছুর রহমান চৌধুরী (কিশোরগঞ্জ-১), শোয়ায়েব আহমদ (সুনামগঞ্জ-২) ও তালহা ইসলাম (নড়াইল-২)।
একটি সূত্র জানিয়েছে, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে সর্বোচ্চ ৫টি আসনে ছাড় দিতে চায় বিএনপি। কিন্তু দলটি বিএনপিকে জানিয়েছে কমপক্ষে ১২টি আসন ছাড়া তারা জোটে যাবে না।
জানতে চাইলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির উবায়দুল্লাহ ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। আলোচনা এখনো চলমান। আমরা বেশ কয়েকটি আসন চেয়েছি, এর মধ্যে বিশেষ কয়েকটি আসন নিয়ে বেশ দরকষাকষি হচ্ছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমাদের চাহিদামতো আসন না দিলে জোট নাও করতে পারি।’