Image description

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলেও অন্তর্বর্তী সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে। সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, সনদ বাস্তবায়নে সরকারের চূড়ান্ত পদক্ষেপ ‘দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে জানা যাবে।’

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সব দলের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছি। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ভালো কিছু হবে।’

ঐকমত্য ব্যর্থ, সরকার এগোচ্ছে নিজস্ব রূপরেখায় : জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর ‘জুলাই সনদ’-এর প্রস্তাবগুলো ২৭ অক্টোবর সরকারের কাছে জমা দেয়। কিন্তু গণভোটের সময়সীমা, ক্ষমতা বণ্টন ও প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও অন্য দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়।

সরকার দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিলেও গতকাল সে সময় শেষ হয় কোনো ঐকমত্য ছাড়াই। ফলে সরকার নিজ উদ্যোগে পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করছে।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবে- এই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সরকার বসে থাকেনি; নিজেদের মতো কাজ করেছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানা যাবে।’

সংবিধান কোনো ম্যাজিক নয় : আইনগত সহায়তা প্রদান (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ খসড়া সংশোধন প্রস্তাব বিষয়ে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘একটি বইয়ের মধ্যে ভালো ভালো কথা লিখলেই সব কিছু ভালো হয়ে যাবে না। সংবিধান কোনো ম্যাজিক নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হয় না।’

তিনি আরো জানান, বিচার বিভাগীয় সংস্কারের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে সাফল্যের দিকগুলো নজরে আসছে না বলেও অভিযোগ করেন।

নির্বাচন ব্যাহত করার সুযোগ নেই : প্রেস সচিব

অন্য দিকে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের মানুষ একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন উপভোগ করবে। কোনো অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক শক্তির পক্ষেই জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত করার সুযোগ নেই।’

তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ দেশে নাশকতা ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। তবে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানান তিনি।

শফিকুল আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রায় সব দলই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটি অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনই জনগণ চায়।’

চিরুনি অভিযানের দাবি ছাত্র সংসদগুলোর : এ দিকে ডাকসু, জাকসু, রাকসু ও চাকসুর সম্মিলিত বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, জুলাই বিপ্লবের অর্জন রক্ষায় সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালাতে হবে।

চার ছাত্র সংসদের ভিপিদের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদী শক্তি পুনরায় দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা এবং সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও অভিযানের তীব্রতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ- জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কাঠামো নির্ধারণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসছে, অন্য দিকে বিরোধী দলগুলো মাঠে অবস্থান বজায় রাখছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী দুই-তিন দিনের ঘোষণাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী রাজনীতির নতুন গতি-সংলাপ না সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে, তা বোঝা যাবে সেখান থেকেই।

আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার রায় : এ দিকে ২০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার রায় প্রদানের জন্য দিন নির্ধারণ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল করা হয়। যদি আদালত এখন রায়ে সেটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ হিসেবে ঘোষণা করে, তবে- সংবিধানে দ্বৈত রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হবে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার, অন্যটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে- এটি কার্যকর করতে সংসদকে তত্ত্বাবধায়ক বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় সংশোধন আনতে হবে। এটি কার্যকর হলে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কিছুটা বাড়বে, কারণ তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নিয়োগে তার অনুমোদন লাগবে। নির্বাহী ক্ষমতার একটি অংশ নির্বাচনের সময়ের জন্য অরাজনৈতিক কাঠামোয় স্থানান্তরিত হবে।

অন্য কিছু বিশ্লেষকের মতে- আপিল বিভাগ রায়ে কী নির্দেশনা দেন তার ওপর এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে। আর অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আসিফ নজরুলের বক্তব্য ঠিক হলে রায়ের আগেই আদেশ জারি হতে পারে।

একটি সূত্র জানিয়েছে- প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় মতভেদের মধ্যে আদেশ জারি করবেন কি না তা নিয়ে ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে আদেশ জারি করতে পারেন। আর নেতিবাচক হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে পরের নির্বাচনের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন।