“বিএনপির কিছু নেতাকর্মী মনোনয়ন না পাওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়ে কি করছে দেখুন”-- এই ক্যাপশনের একটি ভিডিও ঝড় তুলেছে ইন্টারেনেটে। একটি ফেসবুক আইডি থেকে এটি শেয়ার হয়েছে ৬১ হাজারের বেশি বার। রিয়েকশন দিয়েছেন এক লক্ষ ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৫২ লক্ষবারের বেশি। এর বাইরেও বহু আইডি থেকে একই ভিডিও পোস্ট এবং শেয়ার হয়েছে। ভিডিওটির মূল ভার্সনটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে ৪ নভেম্বর রাতে।
ভিডিওর দৃশ্যটি এরকম: টিভির স্ক্রিনে একজন সাংবাদিক খুবই উত্তেজনার সহিত ‘লাইভ’ ধারাভাষ্য বর্ণনায় যুক্ত হয়েছেন একটি ঘটনাস্থল থেকে। আর উত্তেজিত কণ্ঠে অনেকটা চিৎকারের মতো করে বলছেন, “এখানে দেখুন, বিএনপি কর্মীরা মনোনয়ন না পাওয়াতে রেললাইন অবরোধ করছে এবং ভাঙচুর চালাচ্ছে কারণ তারা মনোনয়ন পায়নি। তারা সারাদেশে জ্বালাও পোড়াও এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যারা ক্ষমতার লোভে অন্ধ তারা দেশ চালাবে কীভাবে! তারা শুধু ক্ষমতা চায়। প্রিয় দর্শক আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত শেয়ার করুন।”
ভিডিওটির আর্কাইভ লিংক এখানে।
কথিত সাংবাদিক যখন লাইভ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হয়ে একটি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন এবং পাথর ছুঁড়ে মারছেন।
Riziker rasta - রিজিকের রাস্তা নামক ফেসবুক পেইজ থেকে পোস্ট করা ভিডিওটি শেয়ার করে হাজারো মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাড়ে ৪ হাজারে বেশি কমেন্টের মধ্যে কয়েকশত কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বেশিরভাগ মানুষই ভিডিওটিকে ‘সত্যিকারের ভিডিও’ ধরে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগলে দিচ্ছেন।
উক্ত ভিডিওটির কমেন্টে মিলন মিয়া গনি নামের একজন লিখেছেন, “বিএনপিকে নিষিদ্ধ করা হোক”।
আব্দুল গুফরান লিখেছেন “সুদি ইউনুস থেকে বিএনপি– একাাত্তরের ১৫ই আগস্ট হইতে তারপর থেকে বাংলাদেশকে পিছনে নেওয়ার একমাত্র কারিগরি বিএনপি। তাই বললাম ইউনুস থেকে ভয়ংকর বিএনপি।”
ইয়াকুব লিখেছেন, “সবাই জানে চোরের পাল্লা ভারী বেশি। তবু জনগণ বিএনপিকে ভোট দিবে। ভালো মানুষের খাওয়া নাই।”
বিএনপির বিষয়ে নেতিবাচক ভিডিওটি যারা শেয়ার করেছেন এবং অন্যান্য যেসব আইডি, পেইজ এবং গ্রুপ থেকে ভিডিওটি আলাভাবে পোস্ট করা হয়েছে এরকম অন্তত ১০০টি প্রোফাইল/পেইজ এবং গ্রুপ বিশ্লেষণ করে সেগুলোর বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রোফাইল ও পেইজ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক।
গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আসন্ন জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এ সময়ে বেশ কয়েকটি আসনের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের অনেকে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে। কিছু জায়গায় অবরোধকারীদের দ্বারা ভাঙচুরের খবর মূলধারার মিডিয়া এলেও কোথাও বড় ধরনের ঘটনা বা ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেনি।
মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার কারণে বিএনপি নেতাকর্মীদের দ্বারা ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনা না ঘটলেও তেমন দৃশ্য সম্বলিত যে ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করা হয়েছে সেটি কোথা থেকে এলো?
প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি।
ভিডিওটিতে প্রদর্শিত বিএনপির পতাকার সাথে দলটির প্রকৃত পতাকার মিল পাওয়া যায় না। চ্যানেল ২৪ নামে বাংলাদেশে একটি নিউজ চ্যানেল থাকলেও তাদের লোগোর সাথে ভিডিওটির লোগোর কোনো মিল নাই।
এছাড়া ভিভিওটিতে দেখানো ট্রেনটি বাংলাদেশ রেলওয়ের কোনো ট্রেনের সাথে মিলে না। আবার ট্রেনটির উপরে হিন্দি লেখা দৃশ্যমান। ভাঙচুরের দৃশ্যে বেশ কয়েকজন লোককে দেখা যায় তারা আগুনের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এছাড়া রিপোর্টারের মুখভঙ্গি অস্বাভাবিক ছিলো পুরো ভিডিওটিতে। এসব নিদর্শন থেকে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, ভিডিওটি এআই জেনারেটেড।
যদিও পোস্টে তার উল্লেখ নেই।
বিএনপির বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছড়ানোই পেইজটির কাজ
শুধু উপরের ভিডিওটি নয়, নিয়মিত বিএনপির বিপক্ষে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে নানান ভিডিও পোস্ট করা হয় এই পেইজটি থেকে। এর মধ্যে প্রায়ই ভুয়া তথ্য থাকে বিএনপি সংক্রান্ত ভিডিওগুলিতে।
এই জেনারেটেড ভিডিওতে রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয় পেইজটি থেকে | ফেসবুক
যেমন গত ৫ নভেম্বর পোস্ট করা আরেকটি ভিডিওর ক্যাপশন ছিল, “মনোনয়ন না পেয়ে লজ্জায় নিজের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে”। এবার এআই জেনারেটেড ভিডিওর দৃশ্যটি এরকম: একজন নারী রাস্তায় পড়ে আছেন এবং তাকে ঘিরে আছেন বেশ কিছু মানুষ। ভিডিওটির উপরের অংশে ইনসার্ট করে দেয়া হয়েছে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার ছবি।
ভিডিওতে এক নারী সাংবাদিক বুম হাতে নিয়ে বলছেন, “সুপ্রিয় দর্শক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এখানে একজন সুন্দরী মহিলা মনোনয়ন না পেয়ে লজ্জা, রাগ এবং ক্ষোভে তার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন প্রিয় দর্শক। কমেন্ট বক্সে সেই সুন্দরী মহিলার সুন্দর নামটি আমাদের জানান, ধন্যবাদ।”
ভিডিওটি সাড়ে ৫ হাজার বারের বেশি শেয়ার হয়েছে এবং ৩৮ লক্ষের বেশিবার ভিউ হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, এই ভিডিওটিও এআই জেনারেটেড। বাস্তবে রুমিন ফারহানা ওই দিনের ঘোষণায় মনোনয়ন না পেলেও দলের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে কোন বক্তব্য দেননি, ছাদ থেকে লাফ দেয়া তো দূরের কথা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই পেইজে বিএনপি এবং বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনামূলক এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া তথ্য সম্বলিত ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে ৫০টির বেশি, যার ২১টি ভিউ হয়েছে মিলিয়ন বারের বেশি, এবং কয়েকটি ভিউ ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন পর্যন্ত হয়েছে। তবে বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন বয়ান প্রচার করা হয়েছে।
যেমন ৪ নভেম্বরের একটি ভিডিওর ক্যাপশন হচ্ছে, “আওয়ামী লীগের কর্মীরা ঢাকা রাজ পথে নেমেছে”। ভিডিওতে দেখা যায় এআই জেনারেটেড একটি সাংবাদিক চরিত্র রাস্তায় জড়ো হওয়া বিশাল এক জনতার ঢলের মধ্য থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া একজন তরুণকে জিজ্ঞেস করছেন, “কেন আপনারা রাস্তায় প্রতিবাদ করছেন?” উত্তরে এআই জেনারেটেড প্রতিবাদকারীর চরিত্রটি বলেন, “আওয়ামী লীগ ছাড়া এ দেশে কোন নির্বাচন হবে না, হতে পারে না, এবং আমরা তা হতে দেব না।”
বিএনপির ব্যাপারে নেতিবাচক এমন সাম্প্রতিক কয়েকটি ভিডিও পেইজটি থেকে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। কয়েকটি ভিডিওর শেয়ার সংখ্যা এরকম, ৬১ হাজার, ২৩ হাজার, ১৯ হাজার, ১৬ হাজার, ৬ হাজার।
Riziker rasta - রিজিকের রাস্তা পেইজটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের ১৪ এপ্রিলে। পেইজটির ঠিকানাতে গোপালগঞ্জ জেলার কথা উল্লেখ রয়েছে। পেইজটিতে দুইজন এডমিন রয়েছেন বলে ‘এবাউট’ সেকশনে উল্লেখ করেছে ফেসবুক।
দ্য ডিসেন্ট অনলাইনে অনুসন্ধান করে পেইজটির পরিচালনার সাথে জড়িত দুইজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। তারা হলেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা সোহেল রানা এবং সুমন।
পেইজটির মূল মালিক সোহেল জানান তিনি আগে ঢাকায় একটি মিষ্টির দোকানে সিঙ্গারা-পুরি বানানোর কাজ করতেন। পেইজেও একাধিক ছবি ও ভিডিও আছে যেগুলোতে দেখা যায়, সোহেল ওই মিস্টির দোকানে সিঙ্গারা বানাচ্ছেন বা অন্যান্য কাজ করছেন।
তবে তিনি জানান, সম্প্রতি ঢাকার ওই দোকান থেকে কাজ ছেড়ে তিনি মাদারীপুরে গাড়ির পার্টসের একটি দোকানে কাজ নিয়েছেন।
পেইজটিতে উল্লেখ করা মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করলে সোহেল রানা জানান, তিনি এবং তার ভাগ্নে সুমন এই পেইজের এডমিন। মূলত এআই জেনারেটেড ভিডিওগুলো সুমন বানিয়ে আপলোড করে থাকেন।
এআই সম্পাদিত ভিডিওগুলোতে যেসব ভুয়া তথ্য দেয়া হয়ে থাকে সেগুলো প্রচার করা যে ঠিক না তা কি তিনি জানেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে সোহলে বলেন, ভুল তথ্য মাঝেমধ্যে চলে যায়। চেষ্টা করছি এই ধরনের ভিডিও বানানো বন্ধ করে দেয়ার।
তিনি জানান, রাজনৈতিক ভিডিও বাদ দিয়ে এখন থেকে শুধু ‘ইসলামিক ভিডিও’ বানিয়ে পেইজটিতে পোস্ট করার চিন্তা করছেন।
তবে দ্য ডিসেন্ট-কে সাক্ষাৎকার দেয়ার পরের দুই দিনও দেখা গেছে বিএনপির বিরুদ্ধে এবং নির্বাচন সংক্রান্ত একাধিক ভুয়া তথ্য সম্বলিত এআই দ্বারা নির্মিত ভিডিও পেইজটিতে পোস্ট করা হয়েছে।
যেমন ৭ নভেম্বর রাতে পোস্ট করা একটি ভিডিওর ক্যাপশন ছিল, “প্রধান উপদেষ্টার ভাষ্যমতে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হবে”। যদিও বাস্তবে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস এমন কোন বক্তব্য দেননি।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষিত জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষ্যে যখন এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ দানা বাঁধছে নানান মহলে, তখন আরও অনেক ফেসবুক পেইজের মতো ‘রিজিকের রাস্তা’ নামক পেইজটির কন্টেন্ট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সোহেল তার পেইজ দিয়ে অনলাইনে আয়ও করছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে তিনি জানান, ফেসবুক বিগত মাসে ফেসবুক থেকে তার আয় হয়েছে ৫৮ ডলার।
সর্বশেষ অক্টোবরে কত আয় হয়েছে এ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলে বলতে চাননি সোহেল।
পেইজটিতে প্রথম দিকে নিজের দৈনন্দিন জীবনের নানান ভিডিও পোস্ট করতেন সুমন। সেগুলোর ভিউ কয়েক হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু সম্প্রতি এআই দিয়ে তৈরি রাজনৈতিক ভিডিও দিয়ে সফলতা পাওয়ায় এখন প্রতিদিন এরকম একাধিক ভিডিও পোস্ট করা হয়ে পেইজটি থেকে। এই রিপোর্ট লেখার সময় পেইজটিতে ১ লাখ ৯২ হাজার ফলোয়ার যুক্ত হয়েছেন, যার বেশিরভাগই এসেছে বিগত ২ মাসে; এআই জেনারেটেড ভিডিও দিয়ে নানান ধরনের অসত্য এবং অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার শুরুর পর থেকে।
পেইজের অন্য এডমিন এবং সোহেলের ভাগ্নে সুমন বলেন, “কাজকর্মের ফাঁকে দুই একটা ভিডিও বানাই।”
কী কাজ করেন জানতে চাইলে আর কোন কথা বলতে রাজি হননি তিনি।