দেশের পরিবহন খাতে নতুন করে সংস্কার এখনো যেন অধরা। দুর্নীতি, দখলদারি ও সিন্ডিকেটের জাল ভেদ করে এখনো অক্ষত রয়েছে পরিবহন খাতের পুরনো শক্তি। হাসিনা সরকারের সময়ে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার এনা পরিবহনের দখলে ছিলো পরিবহন সেক্টর। এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হলেও শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জেলা কমিটির সহসভাপতি পদ এবং একই সাথে হয়ে উঠেন পরিবহন সিন্ডিকেটের একচ্ছত্র অধিপতি।
জানা যায়, পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া খন্দকার এনায়েত উল্লাহ চাঁদাবাজি করে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ থাকলেও তার ভাগ পেয়েছেন বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা। গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। তিনি ছিলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া এবং অর্থ পাচারের অভিযোগের বিপরীতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বিরুদ্ধে পুনরায় তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ ছিল, তিনি পরিবহন খাত থেকে দৈনিক গড়ে ১ দশমিক ৫ কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করতেন। তদন্তে উঠে আসে রুট পারমিট বাণিজ্য, অর্থপাচারসহ একাধিক গুরুতর অপরাধের তথ্য। ২০২৫ সালের ৫ মে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ জাকির হোসেন গালিবের আদালত এনা পরিবহন ও স্টারলাইন পরিবহনের মোট ১৯০টি বাস ক্রোকের নির্দেশ দেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন, জব্দ করা বাসগুলো হস্তান্তর করতে। কিন্তু নির্দেশের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কার্যকর হয়নি সেই আদেশ। অভ্যুত্থানের পর খন্দকার এনায়েত উল্লাহ দেশত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে বিক্রি করে ফেলেন এনা পরিবহনের বেশকিছু বাস। কিন্তু সময়ের সাথে দেখা যায় অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্রয় করে এক প্রকার বিনা বাধাতেই আবারো ব্যাবসা পরিচলনা শুরু করেন। জামাল কামাল মোল্লাকে সামনে রেখে বিদেশে বসেই তিনি আবার এনা পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেও উঠে এসেছে নানা তথ্য। বর্তমানে তার মালিকানাধীন ১৫০টির বেশি বাস বিভিন্ন রুটে নিয়মিত চলাচল করছে। বর্তমানে কাগজে অন্যদের নামে মালিকানা দেখানো হলেও বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ এনায়েত উল্লাহ হাতেই রয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মচারী বলেন, এনা পরিবহনের আয় থেকে বড় একটি অংশ এখন পাচার হচ্ছে বিদেশে। আরো একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকা-ে। আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করতে এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিলের জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এই কোম্পানির তহবিল থেকে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন উদ্যোগী হলে এনায়েত উল্লাহর সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া সম্ভব। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে দেশে পরিবহন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, পরিবহন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। এই সেক্টরে যেন কোনো ব্যক্তি বা অশুভ শক্তি হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে হবে। বিদেশে বসে যাতে কেউ পরিবহন সেক্টর অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকেও সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে।