জুলাই অভ্যুত্থান দমাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা মাথায় নিয়ে ভারতে নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার দল আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে তাদের লাখ লাখ সমর্থক এ নির্বাচন বয়কট করবে।
আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা ‘শুধু অবিচারই নয়, এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’ মন্তব্য করে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “পরবর্তী সরকারের বৈধতা আসবে নির্বাচনের মাধ্যমেই। কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে—তারা ভোট দেবে না। যদি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চান, তাহলে এত মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।”
১৫ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেখান থেকেই তিনি প্রথমবারের মত রয়টার্স, এএফপি, ইনডিপেনডেন্টসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যে বুধবার একযোগে প্রকাশ করা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে গত মে মাসে আওয়ামী লীগের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে সে সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও সংশোধন করা হয়।
এরপর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এর ফলে, ছয় মেয়াদে দুই যুগের বেশি সময় সরকারে থাকা দেশের অন্যতম প্রাচীন এ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর অক্টোবরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইন সংশোধন করে নতুন একটি বিধান যুক্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারো বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে তিনি আর নির্বাচন করার যোগ্য হবেন না; জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকলে সেই পদে থাকার যোগ্যতাও তিনি হারাবেন।
ওই নতুন বিধান যুক্ত করার ফলে শেখ হাসিনার ভোটে অংশ নেওয়ার সব সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য দলকে সমর্থন দিতে বলছি না। এখনো আশা করছি, শেষ পর্যন্ত বিবেকের জয় হবে, আর আমাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।”
রয়টার্স লিখেছে, শেখ হাসিনা ওই আশার কথা বললেও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য তার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ‘নেপথ্যে আলোচনা’ চলছে কি না, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যৎ ‘ভূমিকা পালনে’ ফিরে আসবে, সেটা সরকারে হোক বা বিরোধী দলে। তার দাবি, আওয়ামী লীগ তার পরিবারের নেতৃত্ব ছাড়াও এগিয়ে যেতে সক্ষম।
তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত বছর রয়টার্সকে বলেছিলেন, দল চাইলে তিনি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
তবে শেখ হাসিনা হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেন, “এটা আমার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। আমরা সবাই যে বাংলাদেশ চাই, সেখানে ফিরে যেতে হলে সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতি ফিরে আসতে হবে। একক কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।”
রয়টার্স লিখেছে, কয়েক মাস আগে তাদের এক প্রতিবেদক শেখ হাসিনাকে দিল্লির ঐতিহাসিক লোধি গার্ডেনে হাঁটতে দেখেন। সঙ্গে ছিলেন দুজন নিরাপত্তারক্ষীর মত ব্যক্তি। পথচারীদের কেউ কেউ চিনে ফেললে তিনি মাথা নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।
হাসিনা বলেন, “অবশ্যই আমি দেশে ফিরতে চাই, যদি সেখানে বৈধ সরকার থাকে, সংবিধান কার্যকর থাকে, আর আইনশৃঙ্খলা সুষ্ঠু থাকে।”
ক্ষমা চাইতে নারাজ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের অপেক্ষায়। তবে গণঅভ্যুত্থান দমাতে হতাহতের ঘটনায় ‘ক্ষমা চাইতে রাজি নন’ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেনডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাতে তিনি ‘বিস্মিত বা ভীত’ হবেন না। তার ভাষায়, “এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক প্রহসনের বিচার।”
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট সময়ে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।
ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, শেখ হাসিনাকে যখন প্রশ্ন করা হল, জুলাই আন্দোলনে নিহত বিক্ষোভকারীদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, তখন তিনি বলেন, “আমরা একটি জাতি হিসেবে যে সন্তান, ভাইবোন, আত্মীয় ও বন্ধুকে হারিয়েছি, তাদের প্রত্যেকের জন্য আমি শোক করি। আমার এই শোকপ্রকাশ অব্যাহত থাকবে।”
বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও শেখ হাসিনা অস্বীকার করেছেন। বরং বিক্ষোভের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ‘যুক্তিসঙ্গত’ ছিল বলে তিনি দাবি করেছেন।
জুলাই আন্দোলনকে ‘সহিংস বিদ্রোহ’ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো হত্যার দায় ‘স্বীকার করেন না’।
তার দাবি, মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে’ হতাহতের সংখ্যা বেড়েছিল।
“একজন নেতা হিসেবে আমি নেতৃত্বের দায় অবশ্যই স্বীকার করি, কিন্তু আমি নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম–এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানিতে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনে শেখ হাসিনা ‘নিশ্চিত করেছেন’ যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ’ দিয়েছেন।
“তিনি (শেখ হাসিনা) ড্রোন ব্যবহার করে অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যারও নির্দেশ দিয়েছেন। হাসনুল হক ইনুকে তিনি নিশ্চিত করছেন যে নারায়ণগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামানো হবে এবং উপর থেকে ‘বম্বিং’ করা হবে, ‘প্যারাট্রুপার’ নামানো হবে।”
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিও সে সময় আদালতে শোনানো হয়।
গত জুলাই মাসে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন চালানোর অনুমোদন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন–এমন অভিযোগের সত্যতা তারা একটি অডিও টেপ যাচাই করে পেয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্দোলনের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক উপপরিচালক বাবুরাম পান্ত এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা বিক্ষোভ ও মতভিন্নতার প্রতি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অসহিষ্ণুতার প্রমাণ।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফোলকার তুর্কও বলেছিলেন, “বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ ভয়ংকর ও অগ্রহণযোগ্য।”
তবে শেখ হাসিনা নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৪০০ সংখ্যাটি ‘অতিরঞ্জিত’।
আন্দোলন দমাতে সহিংসতার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে তিনি বলেন, “মাঠের কর্মকর্তারা প্রচলিত নির্দেশিকা অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই নির্দেশিকায় নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।”
আর ৫ অগাস্ট দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে শেখ হাসিনা ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, “দেশে থাকলে শুধু আমার জীবন নয়, আমার আশপাশের মানুষদের জীবনও হুমকিতে পড়ত।”