Image description

আমিনুল হক। জাতীয় ফুটবল দলের গোলপোস্টের নিচে এক সময়ের আস্থার নাম, সাবেক অধিনায়ক এবং দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক।

২০০৩ সালে বাংলাদেশ যে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল, তিনি সেই বিজয়ী দলের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ২০১০ সালে তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল জিতেছিল সাউথ এশিয়ান গেমসের স্বর্ণপদক। ১৯৯৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছেন ৪৭টি ম্যাচ। ক্লাব ফুটবলে আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে জিতেছেন অসংখ্য শিরোপা।

মাঠের সেই গোলপোস্ট ছেড়ে আমিনুল হক কালক্রমে এখন রাজনীতির ময়দানে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে তিনি ক্ষুদে ফুটবলারদের নিয়ে নতুন এক প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছেন। সারা দেশে ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে নানা টুর্নামেন্ট আয়োজনেও যুক্ত রেখেছেন নিজেকে। পাশাপাশি রাজনৈতিক-নির্বাচনী ব্যস্ততা তো আছেই।

এর মধ্যেই তিনি একান্ত আলাপ করেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের স্পোর্টস ইন-চার্জ মোয়াজ্জেম হোসেন ও সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) আবির রহমান। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আমিনুল হকের গোলপোস্ট থেকে রাজনীতির মাঠে উত্তরণের গল্প, দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ, প্রবাসী খেলোয়াড়দের ভূমিকা এবং নারী ফুটবলের উন্নতি নিয়ে ভাবনা।

বাংলানিউজ: ফুটবলার থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে উত্থানের পেছনের ইতিহাসটা জানতে চাই। কখন ও কীভাবে মনে হলো যে, আপনার রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত?”

আমিনুল হক: আমার রাজনৈতিক সচেতনতার শুরুটা হয় ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়। দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের পর দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হলো। এরপরের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করল। তখন বিএনপি একটি বিজয় মিছিল করেছিল। আমি তখন রূপনগর টিন শেড কলোনিতে থাকতাম, আব্বা সরকারি চাকরি করতেন। আমার এখনো মনে আছে, বড় ভাইদের সঙ্গে, মুরুব্বিদের সঙ্গে সেই বিজয় মিছিলে গিয়েছিলাম। গায়ে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট।

সেই বিজয় মিছিল করার পর থেকেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রতি আমার একটি ভালো লাগা, একটি শ্রদ্ধাবোধ ও সন্তুষ্টির জায়গা তৈরি হয়। আস্তে আস্তে যখন বড় হতে থাকলাম, তখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে জানতে শুরু করি। ১২ বছর বয়সে তার সম্পর্কে খুব বেশি জানার কথা নয়। কিন্তু ৯১-এর পর যখন বুঝতে শিখলাম, খেলাধুলা শুরু করলাম, তখন জানলাম তিনি কীভাবে একটি আধুনিক, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য দেশের পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে ছুটে বেড়িয়েছেন। খুব অল্প সময়ে তিনি দেশকে সমৃদ্ধ করতে যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন, সেগুলো যখন বুঝতে শিখলাম, তখন থেকেই ওনার প্রতি আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ তৈরি হয় এবং তার কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারি।

তখন থেকেই বিএনপির প্রতি আমার একটি ভালোবাসা ছিল। আমি স্বপ্ন দেখতাম, প্রথমত আমি একজন ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব এবং সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর যদি কখনো সুযোগ হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে কাজ করব। এই স্বপ্ন আমি ছোটবেলা থেকেই লালন করেছি।

সেই স্বপ্ন নিয়েই আমি বাংলাদেশ ফুটবল টিমে খেলা শুরু করি, জাতীয় দলে খেলেছি, বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হয়েছি। বাংলাদেশ ফুটবল টিমের যে সাফল্যগুলো রয়েছে, বিশেষ করে যদি ১৯৯৯ সালের এসএ গেমস (সাউথ এশিয়ান গেমস), ২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ (যা এখন পর্যন্ত পুরুষদের সাফে আমাদের একমাত্র শিরোপা) এবং ২০১০ সালে আমার নেতৃত্বে এসএ গেমসে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে গোল্ড মেডেল জয়ের কথা বলেন—এসবেরই অংশ ছিলাম আমি।

২০১১ সাল পর্যন্ত অধিনায়ক থাকা অবস্থায় আমি জাতীয় দল থেকে অবসর নিই। পরবর্তী দুই বছর, ২০১২ ও ২০১৩ সালে, আমি ঘরোয়া ফুটবল খেলি। এই দীর্ঘ ১৭ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে আমাকে অনেক বড় বড় ইনজুরির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ৫টি বড় অপারেশন নিয়েই, সেই ইনজুরিগুলোকে জয় করে আমাকে বাংলাদেশের গোলপোস্টের নিচে দাঁড়াতে হয়েছে।

শেষবার আমার এসিএল লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। তখন নিজে থেকেও মনে হলো, আর পরিবার থেকেও বলল যে, দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর তো হলো, ৫টি অপারেশনকে জয় করে মাঠে দাঁড়াতে হয়েছে। আমার কাছেও মনে হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ, যতটুকু খেলেছি, দেশের মানুষের জন্য, দর্শকদের জন্য, ফুটবলের জন্য সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

২০১৩ সালে ইনজুরির পর ফুটবল থেকে যখন পুরোপুরি অবসরে গেলাম, তখন ছোটবেলা থেকে লালন করা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভাইয়াকে বুঝিয়ে আমাদের প্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যাই। অবশেষে ২০১৪ সালের ৫ই মার্চ, যখন দেশে একটি ভয়ানক ও দুর্বিষহ পরিস্থিতি চলছিল, তখন আমি এবং আরও বেশ কয়েকজন ক্রীড়াবিদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগদান করলাম।

বিএনপিতে যোগদানের প্রথম দিনই আমাদের মাননীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে, ‘তোমরা যারা আজ দলে যোগদান করলে, আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাদের এই ভালোবাসার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন যেন দল করে, আমি সেদিকে খেয়াল রাখব। ’

সেদিন থেকে আজ অব্দি আমি দলের প্রত্যেকটি কর্মসূচিতে যোগদান করেছি, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়েছি। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের যে লড়াই, সেই সংগ্রামে একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমি সবসময় দলের নির্দেশনা, আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বাংলানিউজ: আপনি অবসরের পর এমন একটি সময়ে (২০১৪ সাল) বিএনপিতে যোগদান করলেন, যখন, আপনার ভাষ্যমতে, দেশে ‘ভয়ানক একটি দুর্বিষহ পরিস্থিতি’ চলছিল। আপনি দলের এমন একটি কঠিন সময়ে বা দুঃসময়ে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলেন। সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করলেন না। আপনি চাইলেই ওই সময় (তৎকালীন ক্ষমতাসীন) আওয়ামী লীগে যোগ দিতে  পারতেন। আপনি একজন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ, সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে এমপি-মিনিস্টারও হতে পারতেন। তারকা ক্রীড়াবিদদের কেউ কেউ তো সেদিকেই গেলেন। কিন্তু আপনি কেন বিএনপিকেই বেছে নিলেন এবং এত মামলা-হামলার পরেও সেই দলেই থেকে গেলেন?

আমিনুল হক: ২০০৯ সালের কথা। আমরা তখন সাফ ফুটবলের সেমিফাইনালে হেরে গেছি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ছিলেন। আমাদের একজন খেলোয়াড় জয় (জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সাবেক উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয়), সে প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল এবং সে তার ফুটবলার পরিচয়কে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়েছে। এ ধরনের অফার কিন্তু আমার কাছেও এসেছিল।

কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই বলেছি, শহীদ জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের যে আদর্শ, ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের যে চিন্তাভাবনা তা আমাকে সবসময় উৎসাহিত করেছে। আমি আওয়ামী লীগ বা তাদের নেতৃত্বদানকারীদের ছোটবেলা থেকে পছন্দ করি না। তাদের ক্ষমতার মোহ আমাকে কখনো আকৃষ্ট করেনি।

আমি চাইলে জয়ের মতোই সেই অফারটা নিতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু মন থেকে আমি তাদের বা তাদের দলের আদর্শকে পছন্দ করি না, এ কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি আমার ন্যূনতম কোনো সফট কর্নার ছিল না।

আমার যেহেতু বিএনপির প্রতি একটি ভালো লাগা ছিল, তাই আমি সবসময় চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের মানুষ যে পক্ষে, আমিও সেই পক্ষে থাকব। আমি ২০১৪ সালে বিএনপিতে যোগদান করি। তখন আমাকে সবাই বলেছে যে, ‘এই মুহূর্তে বিএনপিতে যাবে? বিএনপির যে অবস্থা!’ আমি তখন বলেছিলাম যে, ‘সুসময়ে তো অনেককেই পাওয়া যায়। কিন্তু আমার দলের প্রতি যে অঙ্গীকার, এটা আমি বিএনপির দুঃসময়েই দেখাব। ’ আমি বিএনপির পাশে থেকে একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের মানুষের জন্যই আমার রাজনীতি।

বাংলানিউজ: আপনি যদি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং দলের সিদ্ধান্তে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান, দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের জন্য আপনি কী ধরনের কাজ করতে চান, আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?

আমিনুল হক: দেখুন, যেহেতু আমি একজন ক্রীড়াবিদ এবং দীর্ঘ ১৭ বছর ফুটবলে ছিলাম, তাই আমি জানি বাংলাদেশের ফুটবলের কোথায় কোথায় সমস্যা রয়েছে। একজন ফুটবলার হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় টকশোতে বলেছি আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়, তৃণমূলকে আমরা নতুন করে কীভাবে সাজাতে পারি, জাতীয় ফুটবল দলের জন্য কী কী করণীয়। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত দেখিনি।

আমি বিশ্বাস করি, এই সমস্যাগুলোর বাস্তব সমাধান আমি করতে পারব। বাংলাদেশের মানুষ ক্রীড়ামুখী। এদেশের মানুষ খেলাধুলাকে অসম্ভব পছন্দ করে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান একটি পরিকল্পনা করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, খেলাধুলার মাধ্যমে আমরা সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারব। যেমন, আমরা ক্লাস ফোর থেকে প্রত্যেকটি স্কুলে খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেটকে ন্যাশনাল কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। পাশাপাশি সাউথ এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিক গেমসে ভালো করার সুযোগ রয়েছে, এমন ৫টি ইভেন্টকে আমরা বাছাই করে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করব। পরীক্ষায় পাস করতে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের ওই পাঁচটি ইভেন্টেও পাস করতে হবে।

এতে কী হবে? আমাদের যুবসমাজ, আমাদের সন্তানরা যে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যে ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়েছে, আমরা সেই মাদক ও আসক্তি থেকে তাদের দূরে রাখতে পারব। সর্বোপরি, আমরা একটি সুস্থ জাতি গড়ে তুলতে পারব। সারা বাংলাদেশে খেলার মাঠ খুব সীমিত। আমরা প্রচুর মাঠ সংরক্ষণ করব। সেই মাঠের চারপাশে ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তাতে বাচ্চারা খেলল এবং আমাদের মুরুব্বিরাও পার্কের মতো সেই মাঠে হাঁটার সুযোগ পেলেন।

আমাদের একটি লম্বা পরিকল্পনা আছে। আপনাদের হয়তো মনে আছে, ছোটবেলায় ‘নতুন কুঁড়ি’ নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। জনাব তারেক রহমান আমাকে একদিন বললেন, ‘নতুন কুঁড়ি দেখেছো কখনো? আমরা নতুন কুঁড়ি স্পোর্টস নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিতে চাই। ’ সেই চিন্তা থেকে আমি একটি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছি যে, কীভাবে আমরা উপজেলা থেকে বাছাই করে জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে (যেমন—বাস্কেটবল, সাঁতার, আর্চারি ইত্যাদি) খেলোয়াড় তুলে আনতে পারি।

সবাই তো আর সমান প্রতিভাবান নয়। আমরা বাছাই করে যখন দেখব যে, কোনো খেলোয়াড়ের বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করার সুযোগ রয়েছে, আল্লাহ যদি আমাদের সরকার গঠন করার সুযোগ দেন, আমরা সরকারিভাবে সেই প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের পরিবারসহ তাদের খেলাধুলা ও পড়াশোনার সকল দায়-দায়িত্ব নেব।

আমাদের শুধু ঢাকার বিকেএসপিটাই ভালোভাবে চলছে। আমরা দিনাজপুর, সিলেটের বিকেএসপিগুলোকেও পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় করতে চাই। বাকি বিভাগগুলোতেও বিকেএসপি গড়তে পারলে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আমরা সেই বিভাগেই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারব।

আমাদের তথা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লক্ষ্য—আল্লাহ যদি আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচিত করেন, আমরা ১৮ মাসের মধ্যে এক কোটির বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। এর মাধ্যমে আমাদের যে সাবেক খেলোয়াড়রা আছেন (যারা খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর ভাবেন ‘ভবিষ্যতে আমার কী হবে?’), তাদের জন্য সরকারি চাকরি বা ভাতা এবং যারা বর্তমান জাতীয় বীর, তাদের অবসরের পর সরকারি চাকরির সুযোগ করে দিতে চাই।

বাংলানিউজ: এখন ফুটবলে একটি জাগরণ চলছে, জামাল ভূঁইয়া, হামজা চৌধুরী, কিউবা মিচেল বা ফাহমিদুলের মতো প্রবাসী ভালো ফুটবলাররা দলে আসছেন। হামজা তো বিশ্বের শীর্ষ লিগে (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ) খেলেছেন। তাকে দেখে আরও অনেকেই আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে তাদের মতো গ্লোবাল স্টার তৈরি হচ্ছে না। যার ছাপ জাতীয় দলের খেলাতেও দেখা যায়। এটার জন্য কী ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

আমিনুল হক: শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলায়ও আমাদের অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় সঠিক ফোকাস না থাকা, আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তারা এগোতে পারে না। হামজা চৌধুরী বা জামাল ভূঁইয়ারা আসার পর বাংলাদেশের ফুটবলে একটি নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, খেলার মানও উন্নত হয়েছে। আমরা কখনো হারব, কখনো জিতব। আমরা জিতলে দর্শকদের মাথায় থাকি, হারলে তিরস্কার শুনি। প্রত্যেকটি খেলাতেই এই উত্থান-পতন থাকে।

তবে গ্লোবাল স্টার রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের ফুটবলের স্ট্রাকচার তৈরি করতে হবে। খেলোয়াড়দের মধ্যে শতভাগ পেশাদারিত্ব আনতে হবে, ফেডারেশনের পেশাদারিত্ব আনতে হবে। এই জায়গাগুলো আমরা কখনোই তৈরি করিনি। আমরাই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল, যারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিভাগে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করছি, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করছি। কিছুদিন আগে ভলিবল স্টেডিয়ামে এবং জিয়া উদ্যানের লেকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। আমরা সারা বছরের জন্য একটি ক্রীড়া ক্যালেন্ডার তৈরি করছি।

আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, দেশের প্রায় ৪৯৫টি উপজেলায় একজন সাবেক ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে ‘ক্রীড়া অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। বাৎসরিক ক্যালেন্ডার পরিপূর্ণভাবে পালন করা হচ্ছে কি না, সেজন্য তার সরকারি জবাবদিহিতা থাকবে। এমন অনেক ফেডারেশন আছে, যারা শুধু নামেই আছে, কাজে নেই। সেটা কুংফু হোক, তায়কোয়ান্দো হোক বা কারাতে হোক; আমরা সব সেক্টরেই কাজ করতে চাই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আর্থিক ঘাটতি। আমাদের মূল ফোকাস অবকাঠামো নয়, আমাদের মূল ফোকাস ক্রীড়াবিদ। আমরা কর্পোরেট হাউসগুলোকে সম্পৃক্ত করে ফেডারেশনগুলোকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে চাই, যাতে তারা ক্রীড়াবিদদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে।

বাংলানিউজ: আমাদের নারী ফুটবলাররা অনেক ভালো করছেন। দুইবার সাফ জেতার কীর্তিও গড়েছেন তারা। কিন্তু অধিকাংশই আসছেন প্রত্যন্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে। নারী ফুটবলকে কীভাবে আরও অগ্রসর করা যায়, কীভাবে আরও বেশি বেশি নারী ফুটবলার তৈরি করা যায়?

আমিনুল হক: বাংলাদেশের নারী ফুটবল ও ক্রিকেট দল দুটোই খুব ভালো করছে। বিশেষ করে নারী ফুটবল দলের কথা যদি বলি, আমি ময়মনসিংহে তাদের ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। তারা কিন্তু আর্থিকভাবে খুব বেশি ভালো নেই। তাদের পারিবারিক অবস্থা, আর্থিক সংকট সব মিলিয়ে তারা ভালো নেই। একজন ক্রীড়াবিদ যখন এই চিন্তা নিয়ে মাঠে নামে যে, ‘আমার বাসায় আগামী দিন বাজার আছে কি না’ বা ‘বাবা-মা অসুস্থ, তাদের চিকিৎসা ঠিকমতো করাতে পারব কি না’—তখন সে কখনোই ভালো খেলতে পারে না।

যখন ওই ক্রীড়াবিদের মাথা থেকে তার পরিবারের দায়িত্ব সরকার নিয়ে নেবে, যখন সরকার তার আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ভাতার দায়-দায়িত্ব নেবে, তখন সে মাঠে শতভাগ ফোকাস করতে পারবে। তখন এই ক্রীড়াবিদদের দেখে আরও অনেক নারী ফুটবলার চিন্তা করবে যে, ‘না, আমাদের ফুটবলাররা তো অনেক ভালো আছে। আমিও পড়াশোনার পাশাপাশি একজন নারী ফুটবলার হতে চাই। ’ তখন দেখবেন, শুধু ময়মনসিংহ নয়, সারা বাংলাদেশ থেকে, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে যাদের শারীরিক সামর্থ্য বেশি, তারাও ফুটবলে আসছে।

বাংলানিউজ: ৫ আগস্টের (গণঅভ্যুত্থান) পর আমরা দেখছি আপনি ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। তো এই এক বছরের (অন্তর্বর্তী সরকারের) কার্যক্রমে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?

আমিনুল হক: যদি বাস্তব কথা বলি, আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। ৫ আগস্টের পর ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যেভাবে শুরু করেছিলেন, তিনি সেটা ধরে রাখতে পারেননি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্রিকেট বোর্ড ও ফুটবল ফেডারেশনে হস্তক্ষেপ করেছেন, যেটা তিনি ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে কখনোই করতে পারেন না।

আমি দেখেছি, ক্রিকেট বোর্ড নির্বাচনে তিনি একপক্ষকে (আমিনুল ইসলাম বুলবুল) সমর্থন জানিয়েছেন। যখন দেখলেন তার মনমতো কাউন্সিলর আসে নাই, তখন তিনি বুলবুল ভাইকে দিয়ে চিঠি ইস্যু করিয়েছেন। ক্রীড়া উপদেষ্টা নিজে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ফোন দিয়েছেন। আমি তো শুনে অবাক হয়েছি যে, একজন ক্রীড়া উপদেষ্টা কাউন্সিলরদের ফোন দিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে তাদের মনমতো কাউন্সিলর নির্ধারণ করাচ্ছেন! তাদের দুদকের মামলার ভয়, পুলিশের ভয়, ডিবির ভয় দেখিয়েছেন। এই স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের খুব হতাশ করেছে।

আমরা ১৭ বছর যে স্বৈরাচারিতা দেখেছি, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন শতভাগ দলীয়করণমুক্ত হবে। আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, আমরা বলেছিলাম ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতি করব না। দলীয়করণ বলতে এমন না যে, বিএনপির কেউ খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত হলে তাকে আনলে দলীয়করণ হয়ে যাবে। সে যদি ক্রীড়াবিদ হয়, সে আসতেই পারে। দলীয়করণ বলতে বুঝাচ্ছি—এমপিদের দিয়ে বা যারা স্পোর্টসের সঙ্গে জড়িত না, তাদের দিয়ে ফেডারেশন চালানো। এই বিষয়টা আমরা কখনোই করতে চাই না।

কিন্তু ‘সার্চ কমিটি’র নামে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া লোক এবং স্পোর্টসের সঙ্গে জড়িত নয়, এমন অনেককেই রাখা হয়েছে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে, এনএসসি (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) থেকে একজন বিসিবি পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন, পরে দেখলাম তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। বলা হলো, ‘আমরা তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতাম না। ’ এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। আপনি তাকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে ডিরেক্টর বানালেন, কোন রুলসের অধীনে?

এসব স্বেচ্ছাচারিতা আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটে আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমরা চাই, এটার এখানেই শেষ হোক। আমরা নতুনভাবে এই স্পোর্টসকে সাজাতে চাই, যেখানে কারো কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ থাকবে না।

বাংলানিউজ: আপনি নিউক্যাসল, আল হিলালের মতো ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ইনজুরি ও বিভিন্ন কারণে পারেননি। এই ব্যাপারটা কি এখনো আপনাকে পীড়া দেয়?

আমিনুল হক: আমার প্রথম ডাকটি এসেছিল সৌদি আরবের আল হিলাল ক্লাব থেকে, যখন আমি ২০০০ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলছিলাম। প্রথম পর্বের তিন খেলার পরই তারা আমাকে ওখানেই অফার করেছিল। কিন্তু তখন বয়স কম ছিল, বাবা-মাকে রেখে বিদেশে গিয়ে থাকব—সাহসে কুলায়নি। পরবর্তীতে আমি চলে আসার পর সৌদি ফেডারেশন একটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের দেশের ভালো গোলকিপার বের হচ্ছিল না বলে তারা বিদেশি গোলকিপার রিক্রুট করবে না। যেন দেশের গোলকিপাররা খেলার সুযোগ পায়। এই একটি কারণে আল হিলালে খেলার সুযোগটা আমার হাতছাড়া হয়ে যায়।

পরবর্তীতে নিউক্যাসলে খেলার যে বিষয়টি, সেটি আমাদের সাবেক কোচ জর্ন কোটান (যিনি কিছু বছর আগে মারা গিয়েছেন) ঠিক করেছিলেন। কিন্তু এরপরই আমার স্পাইনাল কর্ডে এমন একটি বড় ইনজুরি হলো যে, প্রায় এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। যদিও আলহামদুলিল্লাহ, সেই ইনজুরি থেকে ফিরে এসেই আমি ২০০৩ সালের সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন দলের অংশ ছিলাম।

পরে একজন ব্রাজিলিয়ান কোচের মাধ্যমে ডেনমার্কে খেলারও একটি সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আবারও একটি ইনজুরির কারণে সেটা হয়নি। তবে এই পীড়ার ভেতরেও একটি ভালো লাগা আছে যে, তখনকার সময়ে আমি একজন গোলকিপার হিসেবে যখনই কোনো বিদেশি কোচের অধীনে খেলেছি, তখনই তিনি আমাকে বলতেন যে, ‘তোমার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে খেলার মতো সামর্থ্য ও যোগ্যতা রয়েছে। ’ এটিই আমার জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি।

বাংলানিউজ: সম্প্রতি প্রবাসী ফুটবলারদের যে ট্রায়াল হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক ভালো খেলোয়াড় এলেও সুযোগ পায়নি। প্রবাসী ফুটবলারদের ঘরোয়া লিগে এনে লিগের মান বাড়ানো যায় কি না, আপনার কী মনে হয়?

আমিনুল হক: আমাদের যারা প্রবাসী ফুটবলার, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। আমাদের বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের মান বা কোয়ালিটি যদি আমরা আরও বাড়াতে পারি, প্রত্যেকটি ক্লাবকে যদি কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারি, তাহলে ঘরোয়া ফুটবলের আবেদন অনেক বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে এটা অবশ্যই করা সম্ভব। আমি যখন প্রত্যেকটি সেক্টরে ও ক্লাবে পেশাদারিত্ব নিয়ে আসব, তখন আল্টিমেটলি আমাদের সেদিকেই যেতে হবে। আমাদের যারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়, তাদের যে আর্থিক সাপোর্ট দরকার, সেটা যদি আমরা বাংলাদেশে নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে তারা কেন বাংলাদেশে খেলবে না?

অবশ্য হামজা চৌধুরীর বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্ন। ও যেখানে খেলছে (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ), সেখান থেকে এনে বাংলাদেশে খেলানোর মতো সক্ষমতা বা বাস্তবতা আমাদের নেই। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তারা বাংলাদেশকে সবার আগে দেখে, বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য দেশের হয়ে খেলছে। আমার মনে হয়, এই যে খেলাধুলার মাধ্যমে ঘরোয়া ফুটবলে একটি নবজাগরণ তৈরি হয়েছে, সেটাকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা ফুটবলে অনেক ভালো কিছু অর্জন করতে পারব।

বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আমিনুল হক: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।