
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) স্বাক্ষর করেনি। এনসিপি সবাইকে অবাক করে জানায়, নিজেদের মতামত প্রতিফলিত না হওয়ায় জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার পেছনে এনসিপির রয়েছে একাধিক রাজনৈতিক কৌশল। শেষ পর্যন্ত জুলাই জাতীয় সনদে এনসিপি স্বাক্ষর করবে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সনদে স্বাক্ষর করার আগে দলটি তাদের বেশ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দফারফায় আসতে চায়। স্বাক্ষর না করার পেছনে জনসমর্থন ঊর্ধ্বমুখী করারও কৌশল রয়েছে। ইস্যুটি ঘিরে নির্বাচনের দাবি করা দলগুলোর সমালোচনা করে চাপে রাখারও কৌশল রয়েছে এনসিপির। তবে এনসিপির শীর্ষ নেতারা সনদে স্বাক্ষর না করা নিয়ে কোনো কৌশল দেখছেন না।
এনসিপির কৌশল সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, সনদে স্বাক্ষর নিয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও দোটানায় পড়ে যায়। দলগুলোর শর্তের বেড়াজালে জুলাই জাতীয় সনদ ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রায় এক বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফসল। অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। সে জায়গা থেকে এনসিপি কৌশল করে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দেয়। এতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে দ্রুত ঐক্য সৃষ্টি করে তোলে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ স্বাক্ষর করতে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছে যায়।
সূত্রগুলো আরও জানায়, বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সনদ স্বাক্ষরে পিছিয়ে থাকে এনসিপি। শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করবে এনসিপি এমন তথ্যও জানা গেছে। সূত্রমতে, এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে ধরে নিয়েই ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। স্বাক্ষর করানোর জন্য দেনদরবার করা হচ্ছে, এ আলোচনাটিও সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত সূত্র আরও জানায়, সনদে স্বাক্ষর একটু পিছিয়ে থেকে এনসিপির জনসমর্থন কী পর্যায়ে আছে, সেটির একটি পরীক্ষাও নেয় তারা। তারা মনে করে, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কিছু ভুল-ত্রুটির ভেতরে পড়ে দলটি এক ধরনেণর জনসমর্থন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে সক্ষম হয়েছে এনসিপি।
সূত্র আরও জানায়, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এক ধরনের অভিযোগ দলটির বিরুদ্ধে বেশ চাউর আছে। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে এনসিপি জানান দিয়েছে, সরকারের সঙ্গে মতবিরোধও রয়েছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এনসিপির কৌশলের মধ্যে আরও রয়েছে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান যেহেতু শেষ হয়ে গেছে, তাই এই মুহূর্তে বড় কিছু রাজনৈতিক দলের নানা কর্মকা- নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ হাতে পেয়েছে এনসিপি। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে না যাওয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এ সুযোগ নিয়ে ওই দলগুলোর কর্মকা-ের সমালোচনা করে জনগণের কাছে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা। তাতে ভোটের রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা পেতে পারে এনসিপি এমন কৌশলও আছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানায়, গত শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আলোচনায় নিয়ে আসতে চেয়েছে এনসিপি। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের ভেতরে থাকা দ্বিধা দূর করতে চেয়েছে দলটি।
মূলত উল্লিখিত এ তিনটি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকতার দিন জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ স্বাক্ষর করেনি এনসিপি। তবে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন নিয়ে দলটির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও সনদবিরোধী এনসিপি সেটি কোনোভাবেই বলা যাবে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আবিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা জুলাই সনদ ২০২৫-এ স্বাক্ষর করব। সেটা তিনটি দাবি আদায় সাপেক্ষে। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা অব্যাহত আছে। স্বাক্ষর না করা কি রাজনৈতিক কোনো কৌশল এমন প্রশ্নে আবিদ বলেন, না, এটি কোনো কৌশল নয়। জনগণ নানা সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রতারিত হয়েছে। এবার সেই সুযোগ দিতে চায় না এনসিপি। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি বলেন, বিয়ে অনুষ্ঠানের চেয়ে গায়েহলুদ অনুষ্ঠান বড় হয়ে যাওয়ার মতো হয়েছে।
এসব কৌশলেই প্রথম দিন সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যায়নি এবং স্বাক্ষর করেনি এনসিপি। তাদের নেওয়া সেই কৌশলে সুফলও পেয়েছে দলটি। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করে সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে সফল করতে পেরেছে।
জানা গেছে, সংস্কারের দাবিতে মাঠে সরব থাকা এনসিপি জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করলেও সরকারের পক্ষ থেকে দলটির সঙ্গে কোনো বৈরী আচরণ না করে বরং সংবেদনশীল আচরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এনসিপির স্বাক্ষর না করার ভেতরে সরকারের সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার ব্যাপার রয়েছে। সেটি আরও স্পষ্ট করে সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য থেকে।
গতকাল রবিবার সচিবালয়ে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ উপদেষ্টা জানান, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করতে পারে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এনসিপি জুলাই সনদের স্বাক্ষর করেনি এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এনসিপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব নেই। রিজওয়ানা হাসান আরও জানান, কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেবে অন্তর্বর্তী সরকার।
সূত্র আরও জানায়, এনসিপির কৌশলের মধ্যে রয়েছে সনদ স্বাক্ষর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে একাধিক রাজনৈতিক দলকে চাপে রাখতে চায় দলটি। এরই অংশ হিসেবে গতকাল দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জামায়াতকে নিয়ে এক ধরনের বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। সেখানে তিনি পিআর পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর আন্দোলন ছিল কৌশলগত রাজনৈতিক প্রতারণা। এটি ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল। আর এর উদ্দেশ্য ছিল গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠনের মূল প্রশ্ন থেকে জাতীয় সংলাপকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া।
সেখানে নাহিদ আরও উল্লেখ করেন, সংস্কারের মূল দাবি ছিল একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে, যা একই সঙ্গে সাংবিধানিক সুরক্ষা হিসেবে ধারণা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের মৌলিক সংস্কার ঘিরে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার এবং জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জামায়াত এবং তার মিত্ররা এই এজেন্ডা হাইজ্যাক করে। এটিকে নিছক কারিগরি পিআর ইস্যুতে রূপান্তরিত করে এবং তাদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
জামায়াতের উদ্দেশ্য ‘কখনোই সংস্কার ছিল না’ দাবি করে নাহিদ ইসলাম বলেন, জামায়াত কখনোই সংস্কার আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের আগেও নয়, পরেও নয়। তারা কোনো মৌলিক প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখায়নি, কিংবা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকার প্রকাশ করেনি। স্ট্যাটাসের একটি অংশে তিনি লেখেন নিজেদের মতামত প্রতিফলিত না হওয়ায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি এনসিপি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি পর্যালোচনা বৈঠক : জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ইতিপূর্বে আলোচিত বিষয়গুলো পুনঃপর্যালোচনা করা হয় বলে জানিয়েছেন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা পবন চৌধুরী।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ভার্চুয়ালি অংশ নেন।
এতে কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।