
নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সারা দেশের মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব খবর প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ দৃশ্যমান এসব খবরের বাইরেও কি কোনো খবর আছে? পর্দার আড়ালে কি কিছু ঘটতে যাচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের অনেকেই এমন প্রশ্ন ছুড়ছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমের মামলায় ২৫ সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারে পরোয়ানা জারি করেছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১১ অক্টোবর গভীর রাতে ভয়ঙ্কর গুজব ছড়ানো হয়।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়ে জামায়াত অনুগত একজন প্রবাসী কন্টেন ক্রিয়েটর তার ইউটিউব চ্যানেলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেশবাসী ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। কয়েক বছর আগে তুরস্কে যেমন প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নির্দেশে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল; তেমনিভাবে সবাইকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয়। অতঃপর রাজনৈতিক দলটির বট বাহিনী সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা ছড়িয়ে দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অথচ পরে দেখা যায়Ñ সবই গুজব। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনার পর গত শনিবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ইতোমধ্যে মামলায় অভিয্ক্তু ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এমনকি ক্যান্টনমেন্টের একটি বিল্ডিংকে অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ চিহ্নিত মহল নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে সেনাবিদ্রোহের গুজব ছড়িয়ে দেয়।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে মুখোমুখি করার ষড়যন্ত্রের ঢেউ থামতে না থামতেই গতকাল জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের নাম ও কণ্ঠ রেকর্ড আছে।’ তিনি উপদেষ্টাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমি সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আজকে হুঁশিয়ারি দিতে চাই না। আজকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’ জামায়াত নেতার এই বক্তব্য প্রচারের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় উঠে। নেটিজেনদের অনেকেই উৎসুক হয়ে জানতে চান, জামায়াত নেতা কি ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করতে চান। কি সেই ষড়যন্ত্র? কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? জামায়াত নেতা তাদের এখনই নাম প্রকাশ করছেন না কেন? নাম প্রকাশ না করে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন কেন? তাহলে কি পর্দার ভেতরে ওই উপদেষ্টাদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের কোনো রাজনৈতিক ডিল হয়েছে? ডিল কার্যকর না করলে সব কিছু ফাঁস করে দেয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছেন? এমন হাজারো প্রশ্ন নেট দুনিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
উপদেষ্টাদের সতর্ক করে এর আগে গত ৭ অক্টোবর নওগাঁর এক সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, কিছু উপদেষ্টা দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছেন এবং কেবল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘এক্সিট’ নেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগোচ্ছেন। যারা এই মানসিকতা পোষণ করেন, তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের খুঁজে বের করবে।’ তারও আগে ৪ অক্টোবর একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন।’ নাহিদ ইসলামের ওই বক্তব্য নেট দুনিয়ায় বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মন্তব্য ও ছবি দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড নেটদুনিয়ায় মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। নেট দুনিয়ায় তোলপাড়ের কারণে গণমাধ্যম থেকে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের সত্যতা জানতে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে যা বলেছেন তা নিছক কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। তিনি নিজেও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন। সরকারের ভেতর থেকে তিনি অনেকের ভূমিকা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। তবে কোন কোন উপদেষ্টা সেফ এক্সিট চান তাদের নামের তালিকা হয়তো তার কাছে আছে।’
গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘যারা নভেম্বরে গণভোটের কথা বলছেন, তাদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে। তারা শর্ত দিয়ে বিভ্রান্ত করে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চাইছে। আওয়ামী লীগের লেজ ধরে চলতে ভালোবাসে জামায়াত। এখনো তারা আওয়ামী লীগের ভোট নেয়ার জন্য কায়দা-কানুন করছে। জামায়াত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচারের জন্য বাহিনী তৈরি করেছে।’
জামায়াতের বিরুদ্ধে নির্বাচন বিলম্বিত করা এবং আওয়ামী লীগের লেজ ধরে চলার অভিযোগের কিছুটা সত্যতা দেখা যায় গভীর রাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকার ও জনগণকে মুখোমুখি করার অপচেষ্টা থেকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর সেনাসদরে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়Ñ সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা যাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের আটক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্যান্টনমেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনীর অবস্থান তুলে ধরে বাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, ‘সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইন মুখোমুখি নয়। একটি বনাম আরেকটিÑ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি দেখা উচিত হবে না। সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’ সেনাবাহিনীর এই অবস্থান জানানো এবং গণমাধ্যমে সে খবর ফলাও করে প্রচারের পরও জামায়াত অনুগত প্রবাসী একজন ইউটিউবার মাদরাসার ছাত্রসহ দলমত নির্বিশেষে সবাইকে তথাকথিত কাল্পনিক সেনাবিদ্রোহ ঠেকানোর আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘গভীর রাতে সেনাবাহিনীর এপিসি (সাঁজোয়াকর্মী বহনকারী যান) রাস্তায় নেমেছে।’ ব্যাপক আলোচিত ওই কন্টেন ক্রিয়েটরের ইউটিউব চ্যানেলে এমন আহ্বানের পর বট বাহিনী সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই ফেলে দেয়। রাতে রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষ ঘুমিয়ে থাকলেও যারা জেগে ছিলেন তারা আতঙ্কে রাত পার করেন। প্রশ্ন হচ্ছেÑ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেন এত ক্ষোভ? সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় কি তার উপর এত ক্ষোভ? এটা তো ঠিক নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সাবেক সেনাপ্রধান নুরুদ্দিন খানকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ দেশে সেনাশাসন জারির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট জেনারেল নুরুদ্দিন তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জনতার পাশে দাঁড়ান। একই ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর। তখন শিক্ষার্থীরা স্লেøাগান দেয়, ‘এ মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার’। কিন্তু হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ানো জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া নিশ্চিত করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়ার বার্তা দেন।
তিনি বারবার বলেছেন, ‘দেশটা আমাদের সবার। সেনাবাহিনী জনগণের পাশেই থাকবে।’ এমন বার্তার পরও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণের মুখোমুখির অপচেষ্টা কেন?
হিন্দুত্ববাদী ভারতের অ্যাজেন্ডা হচ্ছেÑ যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে রাজনীতিতে পুনর্বাসন। আগের সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আগামী সংসদে ‘রিফাইন আওয়ামী লীগ’কে পুনর্বাসনের লক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে কিছু দলকে মাঠে নামানোর পাশাপাশি পশ্চিমা কূটনীতিককে কাজে লাগাচ্ছে। বিদেশি তিনজন কূটনীতিক আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীকে পরিচ্ছন্ন নেতার সার্টিফিকেট দিয়ে তার নেতৃত্বে দল গঠনের লক্ষে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় হয়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী পর্যন্ত মানববন্ধন করে বাংলাদেশ জামায়াতসহ কয়েকটি দল। মানববন্ধনে কিছু দিন আগে য্ক্তুরাষ্ট্রে ‘ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়ে জামায়াতের ৫০ লাখ তরুণ প্রস্তুত রয়েছে’ বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমি সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আজকে হুঁশিয়ারি দিতে চাই না। আজকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রশাসনের যে অবস্থা এবং যে ষড়যন্ত্র চলছে, এটিকে বন্ধ করুন। নিরপেক্ষ সৎ লোকদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করুন। আর যদি না হয়, কোন কোন উপদেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আমাদের কাছে নাম আছে। তাদের কণ্ঠ রেকর্ড আছে। মিটিংয়ে তারা কী বক্তব্য দেন, এর খবর আছে। আমরা জনগণের কাছে আপনাদের এখন প্রকাশ করছি না। সুযোগ দিতে চাই।’ প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াত নেতারা কি উপদেষ্টাদের কিসের সুযোগ দিতে সময় দিচ্ছেন? পর্দার আড়ালে তাদের সঙ্গে কি উপদেষ্টাদের অলিখিত ওয়াদা-ডিল ছিল? এ সময়ের মধ্যে ডিল মতো কাজ না করা হলে জনসমুখে ‘উপদেষ্টাদের ষড়যন্ত্র’ প্রকাশ করবেন? ডিল না থাকলে যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরও কেন তা প্রকাশ না করে উপদেষ্টাদের সময় দেয়া হচ্ছে কেন?