Image description

বিগত এক দশক অনেকটা ‘আড়ালে’ থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে দলটির দৃশ্যমান কার্যক্রম বেড়েছে বহুগুণ। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমানভাবে সক্রিয় দলটি। বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে বিদেশ সফর করছেন দলটির নেতারা। বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও যোগাযোগ বাড়িয়েছেন জামায়াতের সঙ্গে।

গত ৪ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ দেশ ও তিন সংস্থার রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি ও কূটনীতিকরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৫ দেশের রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতের নেতারা।

শরিয়াহ আইনসহ বিভিন্ন ভায়োলেন্স নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রয়েছে, সেসব বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান তারা। আমাদের বক্তব্য শোনার পর তাদের ভাষ্য, আমাদের বিরুদ্ধে শোনা সব মিথ্যা এবং তারা হাসেন। - জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আজাদ

সদ্য শেষ হওয়া সেপ্টেম্বর মাসে কূটনৈতিক পাড়ায় বেশ সক্রিয় ছিল জামায়াত। সবশেষ চারদিনে স্পেন, সুইডেন, আর্জেন্টিনা ও ভুটানের রাষ্ট্রদূতরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেন। পুরো মাসে চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ব্রাজিল, ফিলিস্তিন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, ভ্যাটিকান সিটি, সুইডেন, স্পেন, আর্জেন্টিনা, ভুটান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াত।

সেপ্টেম্বরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজারভেশন টিম জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এছাড়া চাইনিজ পিপলস ইনস্টিটিউট ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ মাসেই দলটির প্রতিনিধিরা মালয়েশিয়ার জাতীয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

সাধারণত বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনের খুব একটা যোগাযোগ থাকে না। তবুও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের ছাত্রশিবিরের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার আমাদের অফিসে এসেছেন। পাশাপাশি চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। - ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম

এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা জাগো নিউজকে জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচন, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম ও ইশতেহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।

জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ইইউ ইলেকশন অবজারভেশন মিশনের প্রতিনিধিদল/ ছবি- সংগৃহীতজামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সুইডেন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস/ ছবি- সংগৃহীত

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না কারার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আমাদের সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। কিন্ত আমরা থেমে থাকিনি। জামায়াতের ওপর হওয়া অত্যাচার, নিপীড়ন নিয়ে কূটনীতিকরা অবগত ছিলেন। জামায়াত ভবিষ্যতে কী করবে- এ বিষয়ে কূটনীতিকরা আমাদের কাছে জানতে চাইছেন। আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিষয়ে তাদের আগ্রহ বেড়েছে।

কথা হয় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে। বৈঠকের বিষয়ে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে কূটনীতিকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে, সব বাধা ছুটে গেছে।

জামায়াতের এই জ্যেষ্ঠ নেতা আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে চলা প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা স্পষ্ট ধারণা নিতে চান। তারা জামায়াতকে জানতে চান, আগামী নির্বাচন বিষয়ে জানতে চান। শরিয়াহ আইনসহ বিভিন্ন ভায়োলেন্স নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রাচার রয়েছে, সেসব বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চান তারা। আমাদের বক্তব্য শোনার পর তাদের ভাষ্য, আমাদের বিরুদ্ধে শোনা সব মিথ্যা এবং তারা (সেসব মনে করে) হাসেন।

পশ্চিমা বিশ্ব- বিশেষত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা আগে জামায়াতকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। তবে তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে যে এই দলের ভেতরে সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। ডাকসু নির্বাচন ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ও তা স্পষ্ট হয়েছে। - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুহুল আমিন

জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কূটনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাৎ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন, স্পেন, আর্জেন্টিনা, কানাডা, জার্মানি, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ভুটানসহ প্রভাবশালী অনেক দেশের প্রতিনিধিরা। এরমধ্যে চীন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। একই সময়ে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ সফর করেছেন জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল।

এসব বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জোবায়ের জাগো নিউজকে বলেন, আগামী ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে। আমরা দেখেছি, পিআর নিয়ে বিভিন্ন দেশের আগ্রহ রয়েছে। তারা আগামীর বাংলাদেশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সচেতন।

কূটনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় ছাত্রশিবিরও

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যক্রমে বেশ সক্রিয় দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের নেতারা বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। গত বছরের ২৭ নভেম্বর চীনের ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করেন ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। চলতি বছর চীন সফর করেন ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম। এছাড়া গত বছরের অক্টোবরে চীন সফর করেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক মুতাসিম বিল্লাহ।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, এনজিও, সংস্থা, অ্যাম্বাসি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা- সবকিছু জামায়াতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম ঘুরছে জামায়াতকে কেন্দ্র করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ জামায়াতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে। ২০২৬ সালে (নির্বাচনে) নতুন কিছুর সূচনা হবে আশা করি।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনের খুব একটা যোগাযোগ থাকে না। তবুও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের ছাত্রশিবিরের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার আমাদের অফিসে এসেছেন। এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। পাশাপাশি চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।

যা বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কূটনীতিকদের এমন ধারাবাহিক বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। এসব বৈঠকের রাজনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে- এ নিয়েও চলছে নানান আলোচনা।

জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত পাওলো ফারনান্দো দিয়াস ফেরেস/ ছবি- সংগৃহীতজামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত পাওলো ফারনান্দো দিয়াস ফেরেস/ ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, এখন জামায়াতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের যে বৈঠক হচ্ছে এটা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত নিয়ে তাদের এত আগ্রহের কারণ হলো, সাধারণত গুপ্ত বা অপ্রকাশ্য জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। ইউরোপ এবং আমেরিকার একটা বৈশিষ্ট্য হলো তারা কোনো কিছু চেক না করে উপসংহার টানে না।

তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছে জামায়াত বা ইসলামি দলগুলোকে মৌলবাদী, উগ্রপন্থির তকমা লাগিয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এটা আওয়ামী লীগের স্বার্থ উদ্ধারের একটা কৌশল ছিল। যদিও ওইসব দেশ সব বিষয়েই অবগত ছিল।

এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব- বিশেষত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা আগে জামায়াতকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। তবে তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে যে এই দলের ভেতরে সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। ডাকসু নির্বাচন ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ও তা স্পষ্ট হয়েছে। ফলে পশ্চিমা কূটনীতিকরা জামায়াতকে নতুনভাবে মূল্যায়ন শুরু করছেন এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা উন্নত রাষ্ট্রগুলোর নীতিগত অবস্থান সহজে বদলায় না। তবে যদি বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক বা জনবিচ্ছিন্ন সরকার থাকে, তাহলে পশ্চিমাদের স্থিতিশীল অবস্থান থাকে না। যদি গণতান্ত্রিক সরকার থাকে, তাহলে তারা সম্পর্ক জোরদার করে। বর্তমানে ইসলামি দলগুলো গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়, বরং গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখছে তারা।

মানবাধিকার, সুশাসন, সুবিচার, অন্তর্ভুক্তি ও প্রকৃত নাগরিক অধিকার- এসব বিষয় ইসলামি দলগুলো সামনে আনতে চায় বলেই পশ্চিমা বিশ্ব এখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আরও উন্নত ও গতিশীল হবে বলে মনে করি- যোগ করেন অধ্যাপক রুহুল আমিন।