
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) একটিও পদে জয় পায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতৃত্বে বিভক্তি, বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং কৌশলগত দুর্বলতাই এ ভরাডুবির মূল কারণ। আন্দোলনের মাঠ থেকে উঠে আসা সংগঠনটি ব্যর্থ হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষক জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নেতৃত্ব পাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি রাজনৈতিক রূপ বাগছাস। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠা সংগঠনটি ডাকসুতে ভালো ফল করবে বলেই ধারণা ছিল। এনসিপিও চেয়েছিল, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তরুণ সমাজে নিজেদের সমর্থন প্রমাণ করতে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে উল্টো প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে।
বাগছাস প্যানেলের অধিকাংশ পদেই একাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ভিপি পদে সংগঠনের বাইরে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তিন হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। জিএস পদে বাগছাসের মুখ্য সংগঠক তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী তৃতীয় হলেও ভোট পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার।
বাগছাস প্যানেলের নেতাদের অনেকেই নিজেদের সিদ্ধান্তে প্রার্থী হয়েছেন, নেতৃত্বের কোনও সমন্বয় ছিল না। এনসিপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রার্থী মনোনয়নে তাদের মতামত নেয়নি বাগছাস নেতৃত্ব। ফলে নির্বাচনে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। শিবির ও ছাত্রদলের মতো বড় দলগুলো যেখানে একক প্যানেল দিতে পেরেছে, সেখানে বাগছাস তা পারেনি।
শিবির মনোনীত প্রার্থীরা ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। ভিপি পদে সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪২ ভোট, যেখানে বাগছাসের প্রার্থী আবদুল কাদের পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ১০৩ ভোট। জিএস ও এজিএস পদেও বাগছাস প্রার্থীরা পাঁচ থেকে ছয় নম্বরে অবস্থান করেছেন। এমনকি বাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন অনেকেই।
বাগছাসের এই ব্যর্থতায় বড় ধাক্কা খেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যদিও বাগছাস আনুষ্ঠানিকভাবে এনসিপির অঙ্গসংগঠন নয়, তবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা ছিল। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন স্বীকার করেছেন, বাগছাসের নেতারা পরিণত নেতৃত্ব দেখাতে পারেননি। বিভক্ত প্যানেল এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে সংগঠনটি।
সংগঠনের অনেক নেতা প্যানেলের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। যুগ্ম সদস্য সচিব আশিকুর রহমান জীম, আবু সালেহীন অয়ন, সানজানা আফিফা অদিতি, রিয়াজ উদ্দিনসহ অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। এর ফলে কর্মীদের নিয়ে প্রচারে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়।
জুলাই আন্দোলনের আলোচিত মুখ রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা বাগছাস থেকে পদত্যাগ করে উমামা ফাতেমার প্যানেলে গিয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক পদে ৪,১২৩ ভোট পেয়েছেন। জীমও ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে আলোচনায় এসেছিলেন, তবে নির্বাচনে মাত্র ৭৯৬ ভোট পেয়েছেন।
বাগছাস শেষ মুহূর্তে এনসিপির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করে। এতে এনসিপির প্রভাবও কমে যায়। তবে শেষ সময়ে কিছু নেতা সামাজিক মাধ্যমে বাগছাসের পক্ষে প্রচারে যুক্ত হলেও সরাসরি মাঠে যাননি এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, জ্যেষ্ঠ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ কিংবা সারজিস আলম।
জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাগছাসের ডাকসুতে ভরাডুবি স্পষ্ট করে দিয়েছে, শুধু আন্দোলনের স্মৃতি বা নৈতিক অবস্থান নয়, একটি সফল নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব। বাগছাস তা দেখাতে পারেনি। আর এই ব্যর্থতা শুধু তাদের নয়, রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলেছে এনসিপিকেও। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়বে, তা সময়ই বলে দেবে।
শীর্ষনিউজ