Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিপুল ভোটে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম)। ঢাবি শাখা শিবিরের সাবেক এই সভাপতি ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছেন। জুলাই আন্দোলনকালীন সাদিক কায়েমের ভূমিকা কেউ না জানলেও ৫ আগস্টের পর থেকেই একের পর এক উঠে আসে সাদিকের অন্তরালের গল্প ও ভূমিকার কথা। শুধু তাই নয়, গণঅভ্যুত্থানের প্রায় ৬ মাস পর সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামির ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমেও জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আলোচনার কেন্দ্রে আসেন জুলাইয়ের এই নায়ক।

জয়ের পরপরই সাদিক কায়েম সম্পর্কে জানার আগ্রহ যেন বাড়ছেই দেশজুড়ে। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিবেদকের সংগৃহীত তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, পাহাড়ঘেরা খাগড়াছড়ি শহরের বাজার এলাকার সাদিক কায়েম। বাবা ব্যবসায়ী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সাদিক। ছোট এক ভাই ও এক বোন পড়েন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে সাদিকের মত ছোট ভাইও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে ‘সালমান’ ছদ্মনামে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সাদিক কায়েম। অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির সংগঠকদের আশ্রয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় ও গণমাধ্যমে নয় দফা পৌঁছে দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। যদিও সাদিকের ভাষায়, তার সংগ্রাম শুধু ৩৬ দিনের জুলায়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, কৈশোর থেকেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এই জুলাইযোদ্ধা।

প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সাদিক কায়েমকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘ছেলেটাকে আমি চিনতাম সালমান নামে, পরিচয় জুলাইয়ের ২৫ তারিখ থেকে। তারপর নিয়মিতই কথা হত। আমার খুব কাছের বন্ধুদের একটা নেটওয়ার্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমন্বয়ককে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করে। মূলত সালমানের সঙ্গে কোঅর্ডিশন করেই সব আয়োজন করা হয়। বয়সে বেশ ছোট সালমানের সঙ্গে বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আমার ও আমার বন্ধুদের। ডিবি কার্যালয় যখন সমন্বয়কদের শীর্ষ নেতৃত্ব আটক, তখন সালমান ও অন্যান্য সমন্বয়করা পুরো আন্দোলনের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।’ সায়েরের ভাষায়, ‘এই তো কয়েকদিন আগেই কথা হলো সালমানের সঙ্গে। কোনো পরিবর্তনই নেই ছেলেটার মধ্যে। নিরহংকার সেই একই সালমান। অন্য সব সমন্বয়কদের থেকে সালমান ও কাদের এই দুই ছেলে একেবারেই ভিন্ন। দুজনের নেতৃত্বই অত্যন্ত বলিষ্ঠ’

সাদিক কি শুধু রাজনীতিই করেছেন? উত্তর ‘না’। আবার শুধু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেই থেমে যাননি ডাকসুর নব-নির্বাচিত এই সহ-সভাপতি। এক্ষেত্রে জুলাইয়ে আহত ও শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে নিয়মিত তাদের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজখবর রেখে আসছেন সাদিক কায়েম। পাশাপাশি তালিকা ও চিকিৎসার জন্যও ব্যবস্থা করেছেন ফান্ডের। শহীদদের স্মরণে প্রকাশ করেছেন জুলাই শহীদ স্মারক।

শাখা শিবির থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাদিক কায়েম ২০১৩ সালে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মূলত ওই সময় থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন তিনি। নেতৃত্ব দিয়েছেন নিজ এলাকায় সংগঠিত নানা ঘটনা, আন্দোলন ও সংগ্রামের। পরে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর হাতে সাদিক কায়েমের রুমমেট সাকিব নিহত হয়। শিবিরের নিহত আরেক কর্মী আবিদও সাদিকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন; তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে গেছেন সাদিক। এর মধ্যে আবিদের চোখ উপড়ে হত্যা করা হয়েছিল; যে গল্প এখনও ক্ষণে ক্ষণে নাড়িয়ে দেয় সাদিকের ভেতরটাকে।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সাদিক খাগড়াছড়ি বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে দাখিল এবং ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ থেকে আলিম পাস করেন। দাখিলে গোল্ডেন জিপিএ-৫ এবং আলিম পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন তিনি। একই সাথে দুটি পরীক্ষাতেই বোর্ড বৃত্তি পেয়েছিলেন সাদিক। এরপর ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ডাকসুর এই নতুন মুখ। স্নাতকে তার সিজিপিএ ছিল ৩.৭৮। এর মধ্যে প্রথম সেমিস্টারে সিজিপিএ ৩.৯৪ পেয়ে হয়েছিলেন প্রথম। ভালো ফলাফলের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রথম বর্ষে সেলিমা এমাজউদ্দিন স্কলারশিপ, দ্বিতীয় বর্ষে মিতসুবিসি স্কলারশিপ এবং তৃতীয় বর্ষে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্কলারশিপ পেয়েছিলেন সাদিক। এ ছাড়াও আরও ৩-৪টি স্কলারশিপ পেয়েছিলেন স্নাতকে ভালো ফল করার জন্য। মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্কলারশিপ পেয়েছিলেন তিনি।

ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের জড়িত ছিলেন সাদিক কায়েম। স্টুডেন্টস এগেইনস্ট ভায়োলেন্স এরিহোয়্যারের (সেইভ) ফ্যাসিলিলেটর তিনি। এর মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল সাদিকের। এ ছাড়া ছিলেন বাংলাদেশ ইয়ুথ ইনেশিয়েটিভের জেনারেল সেক্রেটারি। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন ব্যক্তি সাদিক। ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হওয়াদের পাশেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দাঁড়িয়েছেন সাদিক। এ ছাড়া আন্দোলনে কো-অপারেশন করা, হলে কোনো শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী হলে তাকে উদ্ধার করাসহ নানামুখী এক্টিভিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি।

সাদিক কায়েম ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বুয়েটের আবরার ফাহাদ শাহাদাত পরবর্তী আন্দোলন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সজেন্ডার সংক্রান্ত আন্দোলনে সাবির্কভাবে সহায়তা করেছিলেন তিনি। এছাড়া ফিলিস্তিন নিয়ে যতগুলো এক্টিভিজম হয়েছে, তাতেও সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সাদিক কায়েম।

২০২৪ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ইফতার নিষিদ্ধ হলে ঢাবি ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজন ও সমন্বয় করার পাশাপাশি ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের আয়োজন করায় শাস্তির সুপারিশ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সাদিক। এ ছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে সাদিক কায়েমের। বিভিন্ন সময়ে সহায়তার পাশাপাশি শ্রুতিলেখক হিসেবেও পরীক্ষা দিয়েছেন।

এসবের বাইরে কভিড-১৯ এর সময়ে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন সাদিক কায়েম। সূর্যসেন হলেও অ্যালামনাইদের মাধ্যমে স্কলারশিপ ও এককালীন সহায়তার ব্যবস্থা করেন তিনি। সুবিধাভোগীর পরিচয় গোপন করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেন। এর বাইরেও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা, ভর্তি কেন্দ্রিক সহায়তা, কোচিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।