
ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে ৫ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত পৌনে আঠারো বছরে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী উভয় দলের ওপরই প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চলেছে। বেশি দমন-পীড়নের শিকার হয় জামায়াত যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। দলটিতে ভাঙনও হয়েছে এক দফায়। যদিও ক্যাডারভিত্তিক এ দলটিতে এমন ভাঙনের কথা কখনো কেউ কল্পনাও করেনি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের ষোল বছরে বিএনপির ওপর নিপীড়ন হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে। আর জামায়াতের ওপর নিপীড়নে একই ইস্যুর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের টার্গেটও অন্যতম ছিল।
যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে একের পর এক শীর্ষ নেতাদের যখন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হচ্ছিল ওই সময় একমাত্র বিএনপি ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর অন্য কোনো মিত্র তো ছিলই না, এমনকি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটাও বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে জামায়াত নেতাদের ফাঁসির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ করারও সাহস দেখিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জামায়াতের সঙ্গে এমন মিত্রতা এবং কঠিন সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বিএনপিকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সুশীল বুদ্ধিজীবীদের অনেকে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশ যারা বিগত সময়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রতিবেশী ভারতসহ দেশি-বিদেশি অনেকেই বিএনপিকে ‘জঙ্গী’ এবং ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ তকমা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাতেও উভয় দলের মিত্রতা ভাঙেনি। বিদেশি চাপে পরবর্তীতে এসে মাঝেমধ্যে কৌশলগত কারণে জোট থেকে কিছুটা আলাদা থেকেছে, তবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলনে কর্মসূচিগুলো পালিত হয়েছে উভয় দলের পারষ্পরিক সমঝোতার মধ্য দিয়েই। এমনকি সর্বশেষ জুলাই আন্দোলনেও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সমঝোতা ছিল। এই আন্দোলনে উভয় দলেরই আহত, নিহত এবং গ্রেফতার হয়েছেন অনেক।
বিগত আওয়ামী ১৬ বছরের কঠিন পরিস্থিতির বন্ধনে এটা সবার ধারণা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে কখনো এই দল দুটির মিত্রতায় ফাটল দেখা দেবে না। কিন্তু সেই ভুল ভেঙেছে ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর কিছু দিন পরেই। তখন অবশ্য সবাই বুঝতে পারেনি। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, উভয় দলের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বিএনপির ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে মরিয়া জামায়াত। অন্যদিকে বিএনপিও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে আর কোনো মিত্রতা হবে না। সর্বশেষ, নির্বাচন যেহেতু ঠেকানো যাচ্ছে না তাই জামায়াত শেষ রক্ষা হিসেবে পর্দার অন্তরালে নানাভাবে তদবির চালাচ্ছে, বিএনপির কাছ থেকে নির্বাচনে সুবিধা বা আসনভিত্তিক ছাড় পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে এ পর্যন্ত কোনো সফলতা আসেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দল দুটির ঐক্য-অনৈক্যের অতীত
১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের অধীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতও অংশ নিয়েছিল। অবৈধ এরশাদ সরকারের অধীন নির্বাচনে কেউ অংশ নেবে না, এটা ছিল কমিটমেন্ট। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যারা যাবে এরা হবে জাতীয় বেঈমান- এমন কথা প্রকাশ্য জনসভায় বলার পর ওই রাতেই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নির্র্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন তিনি এ ঘোষণা দেন। এরপরে জামায়াতও নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ঘোষণা করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে। সেই থেকে বেগম খালেদা জিয়া ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে উপাধি পান মানুষের মুখে।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালের ২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দলই আশাতীত সাফল্য পায়। জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। আওয়ামী লীগের সমর্থনে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির ব্যানারে অধ্যাপক গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চলে। নাগরিকত্ব নিয়ে মামলা হয়। মামলায় অধ্যাপক গোলাম আযম নাগরিকত্ব পান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের আয়োজন করা হয়। বিএনপি সরকার এসব পরিস্থিতিতে জামায়াতের পক্ষেই থাকে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেখা গেলো, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক তৈরি হলো।
১৯৯৪-৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে নামে জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের পতন হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুন, ১৯৯৬ যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জামায়াত পায় মাত্র ৩টি আসন। অথচ এর আগে ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পেয়েছিল। ’৯৬ সালের ওই নির্বাচনের পর জামায়াত তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর জন্য বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোটও গঠিত হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই জোট আশাতীত সাফল্য পায়। চারদলীয় জোটের সরকারে জামায়াত দুটো মন্ত্রীত্ব পদ পায়। এই দু’জন মন্ত্রী ক্রয় কমিটিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে স্থান পান। চারদলীয় সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে জামায়াতের মতামতকে গুরুত্ব সহকারেই দেখা হতো।
যেভাবে, যে কারণে মুখোমুখি
কেন, কীভাবে দল দুটি একান্ত ঘনিষ্ঠ মিত্রতা থেকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ালো? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে জামায়াতের উচ্চাভিলাসী ভুল সিদ্ধান্তের কাহিনী। জামায়াতের অনেক আগেরই একটা হিসাব-নিকাশ আছে যে, তাদের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত লড়াইটা হবে বিএনপির সঙ্গে। ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পরে সেই অবস্থানটাই তারা নিয়েছিল। যদিও লড়াইটা বেশ আগে সংঘটিত হচ্ছে বলে তারা বুঝতে পেরেছিলেন তারপরও ঝুঁকিটা তার নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শে। এর সঙ্গে মার্কিন পরামর্শও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই মূলতঃ অন্তর্বর্তী সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করতে পেরেছে জামায়াত। টার্গেট ছিল, ড. ইউনূস সরকার কমপক্ষে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। এরমধ্যে সরকারের সার্বিক সমর্থন নিয়ে জামায়াত নিজেদেরকে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের কাতারে চিহ্নিত করা হবে। এরফলে বিএনপির সমর্থন দ্রুত কমতে থাকবে। এমন হিসাব-নিকাশ থেকেই জামায়াত নেতারা বক্তৃতায়-বিবৃতিতে ‘এক চাঁদাবাজকে হটিয়েছি আরেক চাঁদাবাজকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়’ বলতে থাকেন। পাশাপাশি নিজেরা সারাদেশে দল গঠনের কাজে নেমে পড়েন। এদিকে সরকারি দপ্তরগুলো একে একে সবই নানা প্রক্রিয়ায় দখলে নিতে থাকেন। যেহেতু নিজেদের সরকারি কর্মকর্তা এতোটা নেই তাই আওয়ামী দোসরদের ব্যাপকমাত্রায় দলে ভেড়ান, পদায়ন-পদোন্নতির সুবিধা দিতে থাকেন।
দলের সাংগঠনিক ভিত তৈরিতে শুরুর দিকে ব্যাপক সমর্থন পাবেন বলে মনে হচ্ছিল। সারাদেশে দলটির প্রাথমিক সদস্যের লাখ লাখ ফরমও পূরণ হচ্ছিল। কিন্তু সেটি ছিল সাময়িক। ক্রমান্বয়েই তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারছিলেন। তাই এটা সংশোধনের জন্যও চেষ্টা করেছেন। এই পর্যায়ে প্রথমে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান লন্ডন পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিলেন। তাতে সফল না হয়ে ঢাকায় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাতের অনুমতি পাননি। এরপরে বেগম খালেদা জিয়া যখন লন্ডন গেলেন ওই সময় দু’জনের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন ডা. শফিকুর রহমান। কিছুটা সমঝোতাও হয়েছিল বলে মনে হয়েছে তখন। তবে পরবর্তীতে কী কারণে যেন তা ভেঙে যায়। মূলতঃ এরপর থেকে সম্পর্কেরও চরম অবনতি ঘটে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ব্যানারে নানা অযৌক্তিক ইস্যুতে বিএনপির ওপর একের পর এক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই নির্বাচনের আগেই সংবিধান পরিবর্তন, পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন, জুলাই ঘোষণা প্রভৃতি শর্ত বিএনপি কখনোই পূরণ করতে রাজি হবে না, নির্বাচনও হবে না- জামায়াত ভেবে রেখেছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের কথার বাইরে যাবেন না, এটাও তারা ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সবকিছুই উল্টে গেছে। ড. ইউনূস লন্ডন গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক ও চুক্তি করেছেন। এখন একের পর এক বিএনপির কথাই শুনছেন তিনি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এখন পুরোপুরি বিএনপির পক্ষে। যেই যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে বিএনপি মাইনাস এর পলিসিতে চলছিল তারাও এখন বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছে। আর এসবের প্রেক্ষাপটেই বিএনপি ঘোষণা করেছে, জামায়াতের সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতা হবে না। জামায়াত চেয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হবে। তাতে তাদের প্রধান বিরোধীদল হওয়ার পথ খুলবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না- নির্বাচনে যাবে নাকি বর্জনের পথ ধরবে।
- শীর্ষ প্রতিবেদন