Image description

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সময়ে ঢাকার সাভারে গুমের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন ও যুবদলের দুই নেতা। এর আগে যুবদল নেতার গাড়িচালককেও গুম করা হয়। তাদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে পরিবার থেকে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ। পরে তাদের না ছেড়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে হাজির করে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

গুম হওয়া নেতারা জানান, তাদের প্রথম তিনদিন ‘আয়নাঘরে’ বন্দি রাখা হয়। যেখানে তাদের হাত ও চোখ বাঁধা ছিল। গুম হওয়া ব্যক্তিরা হলেন সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুবদল নেতা সুরুজ্জামান সুরুজ, কাউন্দিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম এবং শহীদুল ইসলামের গাড়িচালক সুজন আহমেদ।

ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাস ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দলের নেতাকর্মী অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। এমন সময়ে সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামসহ সাভারের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং নিয়মিত আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতেন।

ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামকে ধরার জন্য ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট প্রথমে তার গাড়িচালক সুজন আহমদকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। কিন্তু সে সময় তার আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে ডিবিসহ ঢাকা জেলা পুলিশ। তাকে অজ্ঞাত স্থানে ১২ দিন আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে শহীদুল ইসলামের ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান সোসাইটির ভাড়া বাসার সন্ধান পায় ডিবি। এ বাসায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় শহীদুল ইসলাম, সুরুজ্জামান ও মোমিনুল ইসলামকে। তাদের আটকের পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

শহীদুল ইসলাম জানান, তাদের আটক করে কালো কাপড় দিয়ে ছয়দিন হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। ক্ষুধা লাগলে পাউরুটি ও কলার মতো নামমাত্র খাবার দিত। প্রথম তিন দিন যে ঘরে রাখা হয়েছিল, সেখানে বড় বড় ফ্যান চলার আওয়াজ শোনা যেত। শৌচাগারে গেলে হাতের বাঁধন খুলে আলগা করে দিত এবং রশি তাদের হাতে রেখে দিত। ছোট অন্ধকার কক্ষে ছিল না কোনো খাট বা চৌকি।

মোমিনুল ইসলাম জানান, ধারণা করা হচ্ছে ওই কক্ষগুলো ছিল আয়নাঘর। সেখানে দূর থেকে মানুষের আর্তনাদ শোনা যেত। হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের শেষ তিন দিন রাখা হয়েছিল সাভারে ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি কার্যালয়ে। মানুষের কথোপকথন ও গাড়ির শব্দ শুনে তারা এ ধারণা করছেন। এ সময় নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে তাদের দফায় দফায় পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।

যুবদল নেতা সুরুজ্জামান সুরুজ জানান, তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের ফলে তিনি একাধিকবার অচেতন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি নাশকতার সঙ্গে জড়িত মর্মে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।

শহীদুলের স্ত্রী সুরাইয়া হোসেন জানান, এই তিন নেতা পুলিশের হাতে আটক থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তা অস্বীকার করে কিন্তু তাদের উদ্ধার করে ফেরত দেওয়ার কথা বলে পরিবার থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কয়েক কিস্তিতে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। সুরাইয়া বলেন, ‘আমার স্বামীসহ অন্য আটক ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পুলিশের কাছে বারবার ধরনা দিলেও তারা জানিয়েছেন—এমন কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হয়নি। পুলিশ আমাদের দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।’

শহীদুল ইসলাম আরো জানান, শেষ দিন তাদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে নেওয়ার পথে সাভার থেকে ঘুরিয়ে কেরানীগঞ্জ এলাকায় নেওয়া হয়। পথে একটি ছোট তেল পাম্পে তাদের বাসা থেকে ডিবি পুলিশে নিয়ে যাওয়া পোশাক পরিবর্তন করে পরানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সেই পোশাকে তাদের উপস্থাপন করা হয়।

ঢাকা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোবাশ্বেরা চৌধুরী, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীদুল ইসলাম, ঢাকা জেলা উত্তর ডিবির ওসি রিয়াজ উদ্দিন বিপ্লব, ডিবির পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক মিজানুর রহমান, উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদ হোসেন, এসআই আমিনুল ইসলামসহ অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তারা সেখানে দেখতে পান।

তৎকালীন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান তখন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই আসামিরা খুবই ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর অপরাধী। আসামি শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি গ্রুপ সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় নাশকতা কর্মকাণ্ড করে আত্মগোপনে চলে যেত। তাদের রাজশাহী, খুলনা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নাশকতা কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। গাড়িচালক সুজনকে সাভার মডেল থানা বিএনপির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

শহীদুল ইসলাম বলেন, সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপারের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। পুলিশ সুপার সেদিন আরো বলেছিলেন, আসামিরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে সম্প্রতি বাসে আগুন দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেছে। এর মাধ্যমে তারা সরকারবিরোধী কাজে জড়িত। তারা পুলিশের মনোবল ভেঙে দিতে পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে।