Image description
 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অজানা হাওয়ার আশঙ্কা কাটছেই না। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনীতি, কূটনীতি এবং ভোটারদের মধ্যে সংশয় দূর হচ্ছে না। ভোটের ঘোষণার পর সর্বমহলে উচ্ছ্বাসের পরিবেশও দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের প্রস্তুতিতে যেমন ভাটা দেখা যাচ্ছে তেমনি জোষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেখা যাচ্ছে চিন্তার ভাজে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনে যারা বুক চিতিয়ে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে থেকে এসেছে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি।

 

তাঁরা বলছেন, স্বৈরাচার হাসিনার এবং জুলাই গণহত্যার বিচারের আগে কোনোভাবেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে দেবেন না। ভোটের আগে নতুন সংবিধান, সংস্কার শেষ করতে হবে। একই সঙ্গে জুলাই সনদে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না বলেও শক্ত বার্তা দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনার অধিনে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া লাখো তারুণ্য ভোটার এক যুগেরও বেশী সময় ভোট দিতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন সকল দলমত তারুণ্যর কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন সরকার। 

সম্প্রতি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী রোজার আগে অর্থাৎ ছাব্বিশের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সে অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠিও দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে  বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। সবমিলিয়ে দেশে যখন নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে, ঠিক তখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন হলে- তা বিতর্কিত হতে পারে।’

 

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। এজন্য রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। 

 

এছাড়া ভোট গণনার আগ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কা আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।  এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, এখনো গণতন্ত্র নাগালের বাইরে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে নির্বাচন হবে। তবে ভোট গণনার আগ পর্যন্ত তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাবে। নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র চলছে, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারো পাতা ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। একই শঙ্কা দেখা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকেও। তিনি বলেছেন,  গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে বাংলাদেশে আবার পুরোনো সমস্যাগুলো ফিরে আসবে। গত বুধবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেলনিউজএশিয়া (সিএনএ) টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, আমাদের অঙ্গীকার ছিল গণ–অভ্যুত্থানের সময় জাতির যে আকাঙ্ক্ষা, তা নিশ্চিত করা। এগুলো তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। একবার ভাবুন, যদি আমরা নির্বাচন দিয়ে শুরু করি তাহলে আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন নেই, বিচারের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাহলে সবকিছু নির্বাচিতদের হাতে চলে যাবে। কল্পনা করুন, অন্য দুটি কাজ না করে আপনার নির্বাচন হয়েছে। তখন আপনি আবার সেই পুরোনো সমস্যায় ফিরে যাবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সরকারের ঘোষিত সময়ে হওয়া নিয়ে বড় আশঙ্কা রয়েছে। স্বয়ং সরকারের পক্ষ থেকেই বিচার , সংস্কারের আগে ভোট হলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বর্তমান সময়ে দেশের বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও দলটির শীর্ষ নেতারা ভোট গণনার পূর্ব পর্যন্ত নানা ষড়যন্ত্র দেখছেন। সেই সঙ্গে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন জুলাই সনদ, নতুন সংবিধান, বিচার এবং সংস্কারের আগে ভোট হবে না। অন্যদিকে শহীদ পরিবারকে নিয়ে গঠিত যে সংগঠন গড়ে উঠেছে তারাও বলছেন সন্তানদের গণহত্যার বিচারের আগে ভোট হলে তারাও রাজপথে আন্দোলনে নামবেন। এ থেকেও আগামী নির্বাচন তারুণ্যের স্বীকৃতি ছাড়া ভোট অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে।   

এ নিয়ে রাজনীতি, কূটনীতির নির্ভরযোগ্য সূত্রের সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। পাওয়া গেছে অনেক সম্ভাবনা এবং অজানা হাওয়ার আভাস। সূত্রটি বলছে, আগামী অক্টোবর মাস বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঘটতে পারে অনেক কিছু। পরিবর্তন হতে পারে রাজনীতি এবং সরকারের গতিধারা। পাল্টে যেতে পারে ভোটের ঘোষণা। বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি পদত্যাগের সম্ভানাও রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলছে, হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে অনেকগুলো লেয়ার কাজ করছে। দেশের সিংহভাগ মানুষই বাংলাদেশপন্থি। নানা মতবিরোধের মধ্যেই সবার আগে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। রাজনীতির মতদূরত্বের মধ্যেও ঐক্য বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। এর মধ্যেও রাজনীতির আড়ালে ঢুকে পড়ে বিদেশি প্রেশক্রিপশন। অতীতে বাংলাদেশের সকল জাতীয় নির্বাচনে বিদেশি প্রেশক্রিপশন বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, আগামীতেও করবে। এখন থেকেই দেশদুনিয়ার নানা দরবারে চলছে বিশেষ বৈঠক। খোঁজা হচ্ছে আজ আগামীর হিসাব। ভোট প্রসঙ্গ নিয়ে ইতিমধ্যে রাজমাঠে শুরু হয়েছে বাগযুদ্ধ। সব কিছুর মধ্যেই শেষ প্রেসক্রিপশন থাকবে তরুণদের সন্তুষ্ট। বিচারের অগ্রগতির দৃশ্যমান প্রক্রিয়া। 

এ নিয়ে জানতে চাইলে জোষ্ঠ এক রাজনীতিদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার মাত্র ফেব্রুয়ারি ভোট হবে ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যেই আবার সরকারই বলছে বিচার সংস্কারের আগে ভোট হলে পুরনো পথে হাটবে বাংলাদেশ। এ থেকে কি স্পষ্ট হলো সরকার নিজেও ভোটের জন্য প্রস্তুত নয়। তাহলে জনগণ কিভাবে ভরসা রাখবে ভোটের জন্য। হাসিনার নির্দেশে হওয়া গণহত্যার বিচারের আগে এ দেশের সিংহভাগ তরুণ ও জনতা ভোটের জন্য প্রস্তুত নয় বলে যোগ করেন তিনি। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে সব সময় কিছু অজানা সঙ্কেত উড়তে থাকে। এটা অতীতেও ছিলো, এখনও দেখা যাচ্ছে। আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বক্তব্যে অতীতের পুরনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে। তবে আমি মনে করছি, আগামী সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা হয়ে যেতে পারে। তফসিল ঘোষণা হলে তখন সাম্প্রতিক সময়ের বিষয়গুলো স্পষ্ট হতে থাকবে। আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো নতুনভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার জন্য নির্বাচনটা জরুরী। নির্বাচন হয়ে গেলে তখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা স্বাভাবিক হতে থাকবে।আর যে সংস্কারের বিষয়গুলো 
বলা হচ্ছে তখন সেগুলো ধীরে ধীরে হতে পারে।   

রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের নামে গণহত্যার সকল ব্যাক্তি দুর্নীতিবাজদের আবার ফেরত আনা হচ্ছে এটা হতে পারে না। যারা গণঅভ্যুত্থান বিরোধী ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানকে যারা নস্যাৎ করতে চায় তারাই ভোটের পক্ষে বেশী আওয়াজ তুলছেন। লুটপাটের মাফিয়াদের সাথে যাদের গভীর যোগসূত্র তারাই নির্বাচনের বেশী আওয়াজ তুলছেন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এতোই পরিশুদ্ধ থাকতো তাহলে তাদের আন্দোলনেই স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়ে যেতো। তাহলে শিক্ষার্থীদের রাজপথে এতো রক্ত দেওয়া লাগতো না। রাজনৈতিক দলগুলো পারেনি বলেই জনগণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রায় দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। কথা একটাই হাসিনার সংবিধান বাতিল করতে হবে। এখানে কোনো সমঝোতা দেশের মানুষ মেনে নেবে না। জনগণ সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে জবাব দেওয়ার জন্য। তরুণ প্রজন্ম এই মুহূর্তে কী চায় ভোট নাকি বিচার সেটা আপনি তরুণদের প্রতিক্রিয়া দেখলেই বুঝতে পারবেন। আশা সেটি সরকার এবং রাজনীতিবিদরা শীঘ্রই বুঝতে পারবেন।