Image description

হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থান

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার জামায়াতে ইসলামী (জামায়াত বা জেআই) আজ নতুন এক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত। সংগঠনের বিস্তৃত কাঠামো ও শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মীবাহিনীর কারণে তারা ইতিমধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
কৌশলগত মিত্রতা ও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জামায়াত সম্প্রতি গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)-র সঙ্গে নতুন জোটে যুক্ত হয়েছে। এনসিপি গঠিত হয়েছে মূলত শেখ হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দ্বারা। উভয় দল বিএনপির থেকে ভিন্ন অবস্থান নিয়ে মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নীতিকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করছে।
মে মাসে জামায়াত ও এনসিপি যৌথভাবে রাস্তায় নেমে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। অবশেষে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলতে সক্ষম হয়, এবং ইউনুস আওয়ামী লীগকে স্থগিত ঘোষণা করেন।
দমন-পীড়নের ইতিহাস

শেখ হাসিনার শাসনামলে জামায়াত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর দমন-পীড়নের শিকার হয়। দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই— যেমন গোলাম আজম, মতিুর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান— মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলেন বা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিচার প্রক্রিয়াকে গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ বলে সমালোচনা করেছে।
এ ছাড়া শত শত নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয় কিংবা গুম ও হত্যার শিকার হতে হয়। ২০১৩ সালে দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয় এবং ২০২৫ সালের ১ আগস্ট— শেখ হাসিনা ভারত পালানোর মাত্র চার দিন আগে— জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তীব্র দমন-পীড়নের ফলে কিছু জামায়াত কর্মী নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভান করে। কেউ কেউ ছাত্রলীগ বা সরকারি আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করে।
ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন

জামায়াতের মূল লক্ষ্য একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্থানীয় পর্যায়ে তারা দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে ধর্মীয়, সামাজিক, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে তৃণমূল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তবে সমালোচকেরা বলেন, দলটি নারীদের ও সংখ্যালঘুদের সমান অংশীদার হিসেবে দেখে না। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত নারী ও সংখ্যালঘুবান্ধব বক্তব্য দিলেও অনেকেই একে কৌশলগত পরিবর্তন মনে করেন, আদর্শগত নয়।
এছাড়া সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে। ২০২০ সালে ছাত্রশিবির কর্মীরা এক আওয়ামী লীগ কর্মীর শিরা কেটে দেয়। সমালোচকেরা বলেন, জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেয় কেবল শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই। তবে জামায়াতের ভেতরের নেতারা এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেন।
মতাদর্শ ও মওদূদীর প্রভাব

জামায়াতের সংবিধানে স্পষ্ট লেখা আছে:
“আল্লাহ ও নবী মুহাম্মদের নির্দেশ ও নীতির ভিত্তিতেই নীতি প্রণয়ন করা হবে।”
তাদের ওয়েবসাইট ও প্রশিক্ষণ সিলেবাসে মওলানা মওদূদীর রচনাবলি মুখ্য স্থান দখল করে আছে। জামায়াত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রভাবশালী ইসলামী চিন্তাবিদ মওদূদীকে অনেকেই চরমপন্থা প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কিছু গবেষক মনে করেন, তার অবস্থান ঔপনিবেশিক শাসন ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বোঝা উচিত।
মওদূদীর দৃষ্টিতে ইসলামের মৌলিক অনুশাসন যেমন নামাজ ও রোজা, ন্যায়ভিত্তিক শাসন গ্রহণের প্রস্তুতি। ১৯৫১ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের আলেমরা তার কিছু মতকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দেন। তবে মওদূদী মনে করতেন, ইসলামি আইন কেবল ঐতিহ্যবাহী আলেমদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
ক্যাম্পাস ও অনলাইনে প্রভাব বিস্তার

বর্তমান সময়ে জামায়াত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। বিশেষ করে বিএনপি-বিরোধী আলোচনাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তারা সফল হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তারা পরিচয় গোপন করে সক্রিয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে জামায়াত-সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো, যেখানে বিদেশি অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন— অথচ অনেকেই জানতেন না এটি জামায়াত আয়োজিত।
জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির এখন এনসিপির সঙ্গে আলগা জোট গড়ে তুলেছে, ফলে বিএনপির ছাত্রদল ঢাকার ক্যাম্পাসে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগিতার কারণে কলঙ্কের মুখে ছিল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও “’৭১-এর চেতনা”কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের কাছে এর প্রভাব কিছুটা কমেছে। এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামও সম্প্রতি বলেন, “’৭১-এর পক্ষে বা বিপক্ষে’ রাজনীতি দেশকে পুরনো কাঠামোয় ফেরত নিতে চায়।” এ বক্তব্যকে জামায়াত-সমর্থক বলা হচ্ছে।
বৃহত্তর ইসলামপন্থী জোটের পথে

জামায়াত এখন খেলাফত মজলিশ, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী সংগঠনকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলধারায় ডানদিকে সরে যাচ্ছে। বিএনপি, যা এতদিন কেন্দ্র-ডানপন্থী ছিল, এখন হাসিনা-পরবর্তী সময়ে তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকছে।
দেশীয় রাজনীতিতে জামায়াত এককভাবে উল্লেখযোগ্য ভোট পাবে না। এজন্য তারা এনসিপির সঙ্গে জোটে রয়েছে। আরও বড় পরিসরে তারা প্রথম-অতীত-উত্তীর্ণ (FPTP) নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতি চালুর দাবি তুলছে। এতে ছোট দলগুলো বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ পাবে। বিএনপি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রতিধ্বনি

বাংলাদেশে জামায়াতের পুনরুত্থান কেবল দেশীয় রাজনীতির জন্য নয়, বৈশ্বিক ইসলামপন্থী আন্দোলনের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ছাড়া অনেক দেশে ইসলামপন্থীরা সরকারি দমন-পীড়নের মুখে।
বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থানের পেছনে তুরস্কের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এরদোয়ান সরকার অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও আদর্শগত সহায়তা দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
উপসংহার

জামায়াতে ইসলামী আজ এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তারা কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের উত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকে ডানদিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং একইসঙ্গে বৈশ্বিক ইসলামপন্থী রাজনীতির নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

 

মুবাশার হাসান