
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি বিচারিক হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে। পরিকল্পিতভাবে অভিযোগ সাজিয়ে, সাক্ষী তৈরি করে, অনুগত আদালতের মাধ্যমে রায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, পদচ্যুত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহিন, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম গং।
তাদের সহযোগী ছিলেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মরহুম মাহবুবে আলম, গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ হায়দাল আলী, রানা দাশগুপ্ত, জিয়াদ আল মালুমসহ প্রসিকিউটশন টিম। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জুডিশিয়াল কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেন শেখ হাসিনা। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ নামের আত্মজীবনীতে স্বীকার করেন, ‘রায়গুলো গণভবন থেকে আসত।’
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান ওই বিচার সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘বিচার হলেই তো মন্তব্য করার প্রসঙ্গ আসে। ওই সময় যেটা হয়েছে, সেটাকে বিচার বলা মুশকিল। সরকার একটা নির্দেশনা দিয়েছিল আর ট্রাইব্যুনাল সেটি বাস্তবায়ন করেছে।
শেখ হাসিনার জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার নেতাদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা।
এছাড়া আওয়ামী ‘টার্গেটেড’ জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, দলটির নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপি নেতা আবদুল আলীম, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা আবদুস সোবহান ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার। তারা পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে বন্দি অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
যেভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে জুডিশিয়াল কিলিং
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারির মাধ্যমে জেনারেল মঈন উদ্দিনের সহযোগিতায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় বাংলাদেশকে। ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল মঈনের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, কীভাবে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিজয়ী করা হয়েছিল।
এর আগেই ভারতের অনুগতদের মাধ্যমে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠন করা হয়েছিল জরুরি আইনের সময়। তাদের এজেন্ডা ছিল জুডিশিয়াল কিলিংয়ের রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা। নির্বাচনের আগে ভারতের পরিকল্পনা ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘বিজয়ী হলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে’। কিন্তু ক্ষমতায় এসে এই বিচারের নামে রীতিমত জুডিশিয়াল কিলিংয়ের আয়োজন ছিল স্পষ্ট।
সে সময় বিচার চলাকালীন ‘সেফ হাউস কেলেঙ্কারি’ ও ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’ প্রকাশের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং মিশনের চিত্র প্রকাশ পেয়েছিল দৈনিক আমার দেশ-এ। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের অনুগত গণমাধ্যমগুলো এ বিষয় ধামাচাপা দিতেই ছিল ব্যস্ত। বরং উল্টো জুডিশিয়াল কিলিংয়ের পক্ষে জনমত তৈরি করতে মিডিয়া ট্রায়ালে ব্যস্ত ছিল তারা।
সেফ হাউস ও স্কাইপ কেলেঙ্কারি
আল্লামা সাঈদীর মামলায় সেফ হাউসে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকা সাক্ষীদের বিষয়ে আদালতে লিখিত ‘অ্যাফিডেভিট’ দিয়ে বলা হয়েছিল এসব সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে আমার দেশ প্রমাণ করেছিল সাক্ষীরা সবাই ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রিতসেফ হাউসে।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মামলার সাক্ষীরাও আমার দেশ-এর এই প্রতিবেদকের কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন, তাদেরসেফ হাউসে নিয়ে জোরপূর্বক সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এমনকি কেউ কেউসেফ হাউসে শেখানো সাক্ষ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। যদিওসেফ হাউস কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর তৎকালীন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম ও জাহাঙ্গীর হোসেন এক আদেশেসেফ হাউসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করতে অস্বীকার করলে বিচারকের পদ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এ কে এম জহিরকে।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির পুরোটাই ছিল কিলিং মিশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা। নিজামুল হক নাসিম ও তার বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথনে উঠে এসেছিল আদালতের প্রতিটি আদেশ লিখে দিতেন জিয়াউদ্দিনের টিম। সেগুলো শুধু পাঠ করা হতো এজলাসে। এছাড়া স্কাইপ কেলেঙ্কারির বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে। ‘আপনি দাঁড়াইয়া যাইবেন, আমি বসাইয়া দিমু। লোকে বুঝবে আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নাই’। এই উক্তির মাধ্যমেও স্পষ্ট হয়েছিল কীভাবে সাজানো হয়েছে জুডিশিয়াল কিলিং মিশন।
চিহ্নিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করার পরিকল্পনার বিষয়টি মূলত স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত কথোপকথনে উঠে এসেছে।
আত্মজীবনীতে সুরেন্দ্র কুমারের স্বীকারোক্তি
সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ভূমিকা শুধু আপিল বিভাগের এজলাসেই নয়। পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন তিনি। একজন বিচারক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মিশন বাস্তবায়ন পর্যন্ত কীভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তা বর্ণনা করেছেন নিজেই। ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ নামে লেখা বইয়ে ‘রোল ইন দ্য ফরমেশন অব আইসিটি’ শিরোনামে একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে। সুরেন্দ্র কুমারের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের এই অধ্যায়ে স্পষ্ট করেছেনÑ জুডিশিয়াল কিলিং মিশনে কীভাবে পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল গঠন প্রক্রিয়া, বিচারক নিয়োগ, প্রসিকিউশন নিয়োগে তার সংশ্লিষ্টতার কথা অকপটে বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনে ব্যারিস্টার শফিক আহমদ শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর সুরেন্দ্র কুমার শেখ হাসিনাকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কথা তিনি নিজেই বইয়ে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। কিলিং মিশন বাস্তবায়নের টার্গেট নিয়েই তিনি পরিকল্পনা থেকে শুরু করে রায় লেখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আপিল বিভাগে প্রায় সব ফাঁসির রায় তার হাতেই লেখা। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই বিভিন্ন ইন্টারভিউতে স্বীকার করেছেন, রায়গুলো গণভবন থেকে আসত।
এটিএম আজহারের বিচার ছিলÑ ‘গ্রস মিসকারেজ অব জাস্টিস’
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে। এই রায় বহাল রেখেছিল সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ। পরে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে রিভিউ পিটিশন শুনানির অপেক্ষায় থাকাবস্থায় সুরেন্দ্র কুমার বিদায় নিতে বাধ্য হন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এটিএম আজহারের রিভিউ পিটিশনের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয় আপিল বিভাগে। বর্তমান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ শুনানির পর সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি উল্লেখ করেন, সে সময় ‘বিচারের নামে বড় অবিচার’ করা হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করা হয়, উপস্থাপিত প্রমাণাদি ও আইনি উপস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়নের পর আপিল বিভাগ মনে করে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মাধ্যমে আপিলকারীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে গুরুতর বিচারিক বিভ্রাট ঘটেছে।
এছাড়া উল্লেখ করা হয়, পূর্ববর্তী রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি এবং এই গুরুতর বিচ্যুতি বিচারব্যবস্থায় এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
এই বিভাগ গভীর দায়িত্ববোধ থেকে আরো স্বীকার করে, পূর্ববর্তী রায়ে মামলার প্রমাণের দুর্বলতা ও প্রেক্ষাপটকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা বিচারিক নিরপেক্ষতা ও সততার মানদণ্ড থেকে পিছিয়ে ছিল। এই কারণে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীর দণ্ড ও রায় বহাল রাখা যায় না।
রায়ে বলা হয়, এই আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিক দিকগুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি, যা বিচার বিভাগের একটি গুরুতর কর্তব্য ছিল। এই ব্যর্থতা বিচার বিভাগের দায়িত্বে এক প্রকার অবহেলার পরিচয় বহন করে।
আইনজ্ঞরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদ প্রভাবমুক্ত বর্তমান আপিল বিভাগের রায় থেকে এটা স্পষ্ট যে, তৎকালীন ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ শেখ হাসিনার অভিপ্রায় বাস্তবায়নে জুডিশিয়াল কিলিংয়ে মেতে উঠেছিল।
ব্রিটিশ সুপ্রিমকোর্টেও উঠে এসেছে বিচারের নামে অবিচারের কথা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রইব্যুনালে চৌধুরী মুহাম্মদ মঈন উদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনে বসবাসরত মঈন উদ্দিনকে মানবতাবিরোধী অপরাধী উল্লেখ করে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। এটাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন চৌধুরী মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন। এই ঘটনাটি ব্রিটিশ হাইকোর্ট, কোর্ট অব আপিল এবং সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছিল। গত বছরের ২০ জুন সুপ্রিমকোর্ট চূড়ান্ত রায় দিয়েছে। পাঁচজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত আদালতের রায়েও বাংলাদেশের আইসিটির বিচারিক প্রক্রিয়াকে ‘বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রায়ের সামারিতে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে আইসিটির ন্যূনতম ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থতা নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ব্যাপক সমালোচনা করেছিল। শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রিত ট্রাইব্যুনাল ন্যূনতম ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হয়েছিলÑএটা ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টও স্বীকার করে নিয়েছে এই রায়ের মাধ্যমে।
কেস স্টাডি : আবদুল কাদের মোল্লা
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিল। এই রায় ঘোষণার দিনেই ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম ‘রাজনৈতিক মব’। কয়েক স্তরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতই শুধু নয়, নিয়মিত বিরিয়ানি ও খাবার-দাবার সরবরাহ করে দিনের পর দিন চলতে থাকে ফাঁসির দাবিতে স্লোগান।
এই রাজনৈতিক মবকে সামনে রেখেই আইনে পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের এখতিয়ার নিশ্চিত করা হয়। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী স্লোগান ও রাজনৈতিক মবের দাবি অনুযায়ী মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ একজন মাত্র বিতর্কিত সাক্ষীর বক্তব্যকে আমলে নিয়ে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করে। রায়ে আপিল আদালতের বিচারক আবদুল ওয়াহাব মিঞা ভিন্নমত পোষণ করে যাবজ্জীবন বহাল রেখেছিলেন। বাকি সবাই ফাঁসির পক্ষে একমত হন।
আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় মিরপুরের হযরত আলীকে হত্যার ঘটনায় একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বানানো হয়েছিল তার মেয়ে মোমেনা বেগমকে। এই মোমেনা বেগমের তিনটি বক্তব্য রয়েছে ঘটনা প্রসঙ্গে, যা একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত মোমেনার বক্তব্য এক রকম। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত সংস্থার কাছে দেওয়া বক্তব্য এক রকম। আবার আদালতে উপস্থাপিত বিতর্কিত মোমেনার বক্তব্য আরেক রকম। আপিলে শুনানির সময় তিন বক্তব্যের মধ্যে কোনটাকে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ডে নেওয়া হবেÑ এমন প্রশ্ন উঠেছিল। আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘এর মধ্যে আমরা যেটা বিশ্বাস করব সেটা গ্রহণ করব।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত মোমেনার বক্তব্য হচ্ছে, ঘটনার দিনে তিনি শ্বশুরবাড়ি ছিলেন। পরে মানুষের মুখে শুনেছেন বিহারিরা পাকিস্তান আর্মিকে সঙ্গে নিয়ে এসে তার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছেন।
আইসিটির তদন্ত সংস্থার উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ মোমেনা বলেছেন, তার বয়স তখন ১২। তার বাবা হযরত আলীকে হত্যার উদ্দেশে বাড়িতে আক্রমণের সময় ছোট বোনকে নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। বিহারি আক্তার গুণ্ডার বাহিনী ও পাকিস্তান আর্মি তাদের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়েছিল। খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় দেখেছেন কীভাবে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। বিহারি যারা ছিলেন তাদের তিনি চিনতেনÑ এটাও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আবদুল কাদের মোল্লার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই তদন্ত সংস্থার উপস্থাপিত প্রতিবেদনে।
পরে মোমেনা নামে একজনকে নেকাবে আবৃত অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাক্ষ্য দিতে। ক্যামেরা ট্রায়ালে তার সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। সে দিন তিনি বলেছেন, ‘আবদুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন এবং চিহ্নিত করেছেন।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেওয়া মোমেনার বক্তব্য অনুযায়ী, ঘটনার সময় তিনি শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। তদন্ত সংস্থার কাছে দেওয়া বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘বয়স তখন ১২ বছর। খাটের নিচে লুকিয়ে ঘটনা দেখেছেন। আবদুল কাদের মোল্লাকে দেখেন সেটা উল্লেখ নেই তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে। আদালতে নেকাবে আবৃত মোমেনা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন, আবদুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন এবং চিহ্নিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যখন বক্তব্য দেন, তখন ১৯৯৬ সাল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ২০১০ সালে তদন্ত সংস্থার কাছে যখন বক্তব্য দেন, তখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কোনো রকমের বৈরিতা ছিল না। তারপরও মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তিন বিতর্কিত বক্তব্যের একটি গ্রহণ করে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
বিচারের নীতি হচ্ছেÑকাউকে চূড়ান্ত দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীত প্রমাণ হতে হবে। কিন্তু মোমেনার তিন রকমের বক্তব্যের ফলে আবদুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি কোনো মানদণ্ডেই সন্দেহাতীত ছিল না। মূলত জুডিশিয়াল কিলিংয়ের উদ্দেশেই আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় মোমেনাকে সাক্ষী সাজানো হয়েছিল।
কেস স্টাডি : সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
বিএনপি নেতা ও দলের তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলায়ও সাক্ষীদের বক্তব্যে নানা রকমের বৈপরিত্য রয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের দাবি করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ নিয়ে তার সহপাঠী ও তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শামিম হাসনাইন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আদালতে অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার শিক্ষা সনদও উপস্থাপন করা হয়েছিল। সার্টিফিকেট পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধানের প্রতিস্বাক্ষরে সত্যায়িত করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানের লাহোর শিক্ষা কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এটি সত্যায়িত করে দেন। সাধারণ কোনো গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়িত নয়। কিন্তু এসব কিছুই গ্রাহ্য করেনি ট্রাইব্যুনাল এবং সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ। সঙ্গে ছিলেন নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেই এ আদেশ হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দাবি অনুযায়ী, তখন তিনি আসলেই পাকিস্তানে অধ্যয়নরত ছিলেন নাকি দেশেই ছিলেনÑএই বিতর্ক নিরসনে সত্যতা যাছাইয়ের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ। বরং শুনানিতে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান বৈরী রাষ্ট্র। তাদের কোনো কথা গ্রহণযোগ্য নয়।’ তখনই প্রশ্ন উঠেছিল হাইকোর্ট বিভাগে তৎকালীন সিটিং বিচারপতি শামীম হাসনাইনের কথাও কী তাহলে গ্রহণযোগ্য নয়? তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না কেন?
মূলত এভাবেই একের পর এক একরতফাভাবে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দেওয়া হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে।
কেস স্টাডি : মতিউর রহমান নিজামী
এ মামলা চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী পাবনার অ্যাডভোকেট নান্নুর একটি ভিডিও বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছিল। ভিডিও বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন, কীভাবে তাকে সাক্ষ্য বানানো হয়েছিল। কোন পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বানোয়াট সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন।
৫ আগস্টের পর আরো চারজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা প্রত্যেকেই স্বীকার করেনÑজোর করে তাদেরসেফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বানোয়াট সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে তাদের নানামুখী চাপ দেওয়া হয়। মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী তোফাজ্জল মাস্টার প্রাইমারি স্কুলে মতিউর রহমান নিজামীর সহপাঠী ছিলেন।
তোফাজ্জল জানান, মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে তাকে চাপ দেওয়া হলে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে মেয়ের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। সেখানে র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে নিয়ে যায়সেফ হাউসে।সেফ হাউসে চাপের মুখে তিনি শেখানো সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে তার গায়েও হাত তোলা হয়।
আরেক সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আবু শ্যামা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান নিজামীর নামও শুনেননি তিনি। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের সময় তিনি নিজামীকে দেখেছেন। এর আগে কখনো দেখেননি। তাকে যে ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বানানো হয়েছিল ওই ঘটনাও তিনি দেখেননি এবং মতিউর রহমান নিজামীর নামও শোনেননি তখন। জোর করে তাকে দিয়ে এই ঘটনার কথা বলানো হয়েছিল বলে দাবি তার।
অন্যদিকে স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত আলোচনায় বিচারক নিজামুল হক নাসিম বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া, একটা রায় চায়’, ‘আমি দাঁড়াইয়া যামু, আপনি বসাইয়া দেবেন, লোকে বুঝবে আমাদের মাঝে সম্পর্ক নাই’Ñ এই উক্তিগুলোর মাঝেই স্পষ্ট জুডিশিয়াল কিলিংয়ের টার্গেট নিয়েই সাজানো হয়েছিল বিচারের নাটক। যেমনটা নিজামুল হক নাসিম তার বন্ধু আহমদ জিয়াউদ্দিনকে স্কাইপ কথোপকথনে বলেছিলেন, ‘আজো ট্রাইব্যুনালে নাটক ভালোই হয়েছে। আমি হলাম এই নাটকের অভিনেতা।’
সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : বিচার ছিল ডিক্টেটেড
আওয়ামী লীগ আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ডিক্টেটেড বিচার হয়েছিল বলে মনে করেন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান।
শাহ আবু নাঈম আমার দেশকে বলেন, ‘ওই সময় তো আর আইন ও বিধিবিধান দেখে বিচার করা হয়নি। সরকার একটি নির্দেশনা দিয়েছিল আর ট্রাইব্যুনাল সেটা বাস্তবায়ন করেছে, যার প্রতিবেদন দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমেও এসেছে। সে সময় যে বিচার হয়েছে, সেটা নিয়ে মন্তব্য করার মতো নয়। কারণ বিচার হলেই তো মন্তব্য করার প্রসঙ্গ আসবে। ওই সময় যেটা হয়েছে, সেটাকে বিচার বলা মুশকিল। এখন সেসব ঘটনা অতীত হয়ে গেছে। যারা প্রাণ দিয়েছেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের আত্মীয়রা চাইলে সেটার বিষয়ে উচ্চ আদালতে এখন প্রতিকার চাইতে পারেন। অন্তত প্রকৃত সত্যটি বের করার জন্য হলেও।’
বিগত আওয়ামী লীগের সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে বিচার বলতে নারাজ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘ওই সময় শেখ হাসিনার ইচ্ছে হয়েছে কিছু লোককে হত্যা করতে হবে, সেটা তিনি বিভিন্ন উপায়ে করেছেন। কাউকে গুম করে হত্যা করেছেন। আবার কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছেন। সবকিছুই তার ইচ্ছেমাফিক হয়েছে। বিচারের নামে তিনি প্রতারণা করেছেন জাতির সঙ্গে। তার ওই বিচারিক প্রতারণার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ।’
ভুক্তভোগীদের পক্ষের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী বলেন, বিচারিক হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার হয়েছিলেন আবদুল কাদের মোল্লা। এটি ছিল আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের দ্বারা সংঘটিত প্রথম হত্যাকাণ্ড। তারা আইন পরিবর্তন করেছিল শুধু হত্যাকাণ্ড সম্পাদনের জন্য। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করতে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করেছিলেন। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া।
এহসান এ সিদ্দিকী আরো বলেন, ‘তারা সাক্ষ্য আইনের এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যাতে সাক্ষীদের পূর্ববর্তী অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। ফলে আদালতের বাইরে দেওয়া সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ব্যবহার করে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের জেরা করা সম্ভব হয়নি।
আবদুল কাদের মোল্লার মামলার রায় ব্যবহার করা হয়েছিল জামায়াত ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য। এমনকি যখন দণ্ড দেওয়ার মতো কোনো প্রমাণই ছিল না, তখনও আপিল বিভাগ নিজেরাই প্রমাণ সৃষ্টি করেছিল। এ রকমই ঘটেছিল মাওলানা নিজামীর মামলায়। সেখানে সাক্ষীরা দাবি করেছিলেন যে, তারা চাঁদের আলোয় মাওলানা নিজামীকে দেখেছে, অথচ সেই রাতে কোনো চাঁদই ছিল না। বিচারপতি নাজমুন আরা রায়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, সাক্ষী নাকি প্রদীপের আলোতে মাওলানা নিজামীকে দেখেছিল।