Image description

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যরা সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর জন্য সরকার ও শাসক দল একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের সময়ে সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার, বিচারপূর্ব আটক, ব্যয়বহুল ফৌজদারি বিচার, জরিমানা ও কারাদণ্ডসহ নানাবিধ হুমকির মুখে ছিলেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আগস্টে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্টে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, স্বাধীন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গোয়েন্দা সংস্থা আংশিকভাবে গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করত সরকারি বিজ্ঞাপন আটকে রেখে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিজ্ঞাপন না দিতে চাপ দিয়ে। যেসব গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করতো বা রাজনৈতিক বিরোধীদের কার্যক্রম, বক্তব্য প্রচার করতো তাদের বিরুদ্ধে ওই সরকার এমন শাস্তি দিত। 

রিপোর্টে আরও বলা হয়, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আগের সরকারের সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সীমাবদ্ধ। মিডিয়ার সদস্যরা এবং ব্লগাররা সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে হয়রানি ও প্রতিশোধের আশঙ্কায় নিজেরাই সেন্সরশিপ আরোপ করেন। সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করে যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের অভিযোগে সাইবার নিরাপত্তা আইনের (সিএসএ) ২০২৩, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬ এর অধীনে কমপক্ষে এক হাজার ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা হবে। অক্টোবর ও নভেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্ববর্তী সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ১৬৭ জন সাংবাদিকের পরিচয়পত্র (অ্যাক্রেডিটেশন) বাতিল করে। অ্যাক্রেডিটেশন ছাড়া সাংবাদিকরা সংবাদমাধ্যমে লিখতে ও প্রকাশ করতে পারলেও সচিবালয়ে বা মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে সচিবালয়ের ভেতরে অনুষ্ঠিত সরকারি অনুষ্ঠান বা সংবাদ সম্মেলন কাভার করার সুযোগ হারান তারা।

সংবিধান অনুযায়ী সংবিধানের সমালোচনা করা দেশদ্রোহিতার সমান অপরাধ। দেশদ্রোহিতার শাস্তি তিন বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আইনে ঘৃণাবিষয়ক বক্তব্যে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেয়া নেই। ফলে তা সরকারের জন্য বিস্তৃত ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে। সরকার এমন বক্তব্য সীমিত করতে পারে-যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিরুদ্ধে, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার বিরুদ্ধে, অথবা যা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধে প্ররোচনার শামিল। আইন অনুযায়ী সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর সমালোচনা অপরাধ হিসেবে গণ্য। সাইবার নিরাপত্তা আইনের (সিএসএ) অধীনে পুলিশকে ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বাতিল হওয়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) অধীনে শুরু হওয়া মামলাগুলো সিএসএ’র অধীনে চলতে থাকে। পূর্ববর্তী সরকার এই আইন ব্যবহার করেছে সরকার বা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যম ও আইন মন্ত্রণালয় জানায়, আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের আটটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে আইসিটি আইন, ডিএসএ এবং সিএসএ-এর অধীনে মোট ৫,৮১৮টি মামলা বিচারাধীন ছিল, যার মধ্যে একটি মামলার আসামি ছিল একজন কিশোর।

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এইচআরএসএস জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৯টি সিএসএ ও ডিএসএ মামলায় ১২ জন গ্রেপ্তার এবং আরও ৬২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাওয়া বক্তব্যের বিরুদ্ধে, এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানরত মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধেও। সেপ্টেম্বরে খুলনায় একদল জনতা উৎসব মণ্ডল নামে এক কিশোরকে ফেসবুকে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে পিটিয়ে আহত করে। তার বিরুদ্ধে সিএসএ-এর অধীনে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগে মামলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে হেফাজতে নেয়, যেখানে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দেয়, পূর্ববর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা-সংক্রান্ত ‘বক্তব্যভিত্তিক অপরাধের’ মামলা যার মধ্যে সিএসএ, ডিএসএ ও আইসিটি আইনের অধীনে হওয়া মামলা অন্তর্ভুক্ত, তা প্রত্যাহার করা হবে। 

আইন মন্ত্রণালয় জানায়, এসব মামলায় আটক ব্যক্তিদের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেয়া হবে। মোট ৫,৮১৮টি বিচারাধীন মামলার মধ্যে ১,৩৪০টি চিহ্নিত হয় ‘বক্তব্যভিত্তিক অপরাধ’ হিসেবে, আর বাকি মামলাগুলো ছিল ‘কম্পিউটারভিত্তিক অপরাধ’ যেমন হ্যাকিং ও ডিজিটাল প্রতারণা।

শারীরিক হামলা, কারাবাস ও চাপ

পূর্ববর্তী সরকারের আমলে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। বিশেষ করে এসব ঘটনা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ডিএসএ’কে সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর জন্য সরকার ও শাসক দলের একটি হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১১৫টি ঘটনায় ৩৮৮ জন সাংবাদিক হয়রানি ও হামলার শিকার হয়েছেন। জুলাই ও আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময় পাঁচজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে গুলিবিদ্ধ হন। মানবাধিকার সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাংবাদিকদের ওপর হামলা বা হয়রানির ১২০টি ঘটনায় দুইজন নিহত এবং ১২৮ জন আহত হয়েছেন। মার্চ মাসে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত দৈনিক দেশ রূপান্তরের সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানাকে স্থানীয় প্রশাসকের দপ্তরে তথ্য সংগ্রহের সময় এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে ‘অশোভন আচরণের’ অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। রানা সরকারি প্রকল্পে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ক্রয়ের তথ্য জানতে দপ্তরে আবেদন করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তথ্য না পাওয়ার বিষয়ে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়লে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসান। জুন মাসে রানা অভিযোগ থেকে খালাস পান।

মুদ্রিত ও অনলাইন উভয় ধরনের স্বাধীন গণমাধ্যম সক্রিয় ছিল এবং নানা ধরনের মত প্রকাশ করছিল। তবে পূর্ববর্তী সরকারকে সমালোচনা করা গণমাধ্যমগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হতো। পূর্ববর্তী সরকারের সময় স্বাধীন গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে বা বাধাহীনভাবে কাজ করতে পারেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হলেও কিছু সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, কী বিষয় কাভার করা যাবে তা নিয়ে পরোক্ষ চাপ রয়ে গেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পূর্ববর্তী সরকার ১৯১টি ওয়েবসাইট বন্ধের নির্দেশ দেয়, যেগুলোকে “রাষ্ট্রবিরোধী সংবাদ” প্রকাশের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সরকারের পরিবর্তনের পর এই সাইটগুলোর অনেকগুলো পুনরায় চালু হয়। সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, পূর্ববর্তী সরকারপন্থী হিসেবে বিবেচিত সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগের ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। যার কিছু অভিযোগ ছিল অপ্রমাণিত বা চাঁদাবাজির মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। 

আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অন্তত চারজন সিনিয়র সাংবাদিক-ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু এবং শ্যামল দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সংবাদ কাভারেজ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে বলে বিবেচিত হয়।

সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করা সংগঠন ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’-এর (সিপিজে) তথ্যমতে ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত আগস্ট মাসে দায়ের হওয়া এক আইসিটি মামলার দুই ডজনেরও বেশি অভিযুক্ত সাংবাদিকের অন্যতম। সেখানে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা গণআন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত ছিলেন। একই রিপোর্টে বলা হয়, আরও ২৮ জন সাংবাদিক গণআন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মামলায় তদন্তাধীন।