Image description

নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে এমন নিয়ম প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি জানিয়েছে, এতে তাদের আপত্তি নেই। তবে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, আরপিও সংশোধনের আগে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া উচিত ছিল ইসির।

আবার যেসব ছোট দলে পরিচিত নেতৃত্ব বা মুখ রয়েছে, তারা নিজ দলের প্রতীকে ভরসা রাখলেও অন্য ছোট দলগুলো আগের মতো বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের সুযোগ অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।

সংশোধিত আরপিওর চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে দলীয় প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে হবে। এ খসড়া সরকারের অনুমোদন পেলে বড় দলের সঙ্গে জোট করলেও অতীতের মতো সেই দলের প্রতীকে নির্বাচন করা যাবে না। নিজ দলের প্রতীকেই ভোটের পরীক্ষায় নামতে হবে।

একানব্বইয়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাকশালের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে সংসদে যান। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি (না-ফি) এবং ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। 

অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন
পরের নির্বাচনগুলোয় এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। ছোট দলগুলো যেসব আসনে বড় দলের কাছ থেকে ছাড় পেয়েছে, সেখানেই ধানের শীষ, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছে। তবে জোটে থাকলেও জাতীয় পার্টি (এরশাদ) বরাবরই নিজ প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করেছে। 

আবার নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ২০১৮ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনে দলটি নিজের প্রতীক হাতপাখা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীরা নৌকায় চড়ে সংসদে যান। ওই নির্বাচনে বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থীরা নির্বাচন করেন ধানের শীষ প্রতীকে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটসঙ্গীদের আবার নিজের প্রতীক দেয়। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও এর পুনরাবৃত্তি হয়। ‘রাতের ভোট’খ্যাত ২০১৮ সালে বিকল্পধারা, জেপি, তরীকত ফেডারেশনকেও ভোট করতে নৌকা প্রতীক দেয় আওয়ামী লীগ। 

২০১৮ সালে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, জমিয়ত, খেলাফত মজলিস ও বিজেপি। অনিবন্ধিত জামায়াত, জাতীয় পার্টি (জাফর), নাগরিক ঐক্য, লেবার পার্টি, এনপিপি, মাইনরিটি পার্টি, পিপিবির প্রার্থীরাও বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেন ধানের শীষ প্রতীকে। 

আগামী নির্বাচনে কী চিন্তা
আগামী নির্বাচনে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে জোট করে ভোটে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। ধারণা করা হচ্ছিল, জোট শরিকদের ধানের শীষ দেবে দলটি। আরপিওর সংশোধনে এ সুযোগ বন্ধ হলেও এই উদ্যোগকে ভালো চোখেই বিএনপি। 

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আরপিওর খসড়ায় আপত্তি নেই বিএনপির। নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে প্রার্থীকে– এ নিয়মে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, শিগগিরই এ বিষয়ে দলগতভাবে মতামত তুলে ধরবে বিএনপি। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান করার প্রস্তাব বিএনপিরই ছিল। কারচুপি হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে ফিরিয়ে দেওয়াও ভালো উদ্যোগ। তবে এর যাতে অপব্যবহার না হয়। ‘না’ ভোটের বিধান ফিরে আসাও ভালো। বিএনপিসহ পুরো জাতির দাবি ছিল, ইভিএম বাতিল করা। ইভিএম বাতিলকে বিএনপি ভালো মনে করছে। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করাও ভালো সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি। 

আগামী নির্বাচনে জামায়াত পৃথক নির্বাচনী জোট গঠন বা বৃহত্তর সমঝোতা তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপিবিরোধী বৃহত্তর বলয় গড়তে তারা ধানের শীষের বিরুদ্ধে একক প্রতীকে নির্বাচন করার পরিকল্পনাও করছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর নিবন্ধন এবং দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফিরে পাওয়া জামায়াতের অভিযোগ, বিএনপির প্রতি ইসির পক্ষপাত রয়েছে। এ কারণে তারা আরপিও সংশোধনের এই উদ্যোগকে পর্যবেক্ষণ করছে। দলটির সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে ‘ধানের শীষ বনাম দাঁড়িপাল্লার লড়াইয়ে’ পরিণত করার চেষ্টা রয়েছে জামায়াতের। বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতা হলে, মিত্রদের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক দিতে চায় তারা।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, আরপিও সংশোধনে ইসি প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেনি। ইসি আরপিওর সংশোধনীর খসড়া পাঠানোর পর তারা আনুষ্ঠানিক মতামত জানাবেন। 

অন্য দলগুলো কী বলছে
গণসংহতি আন্দোলন জোট শরিকের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ রাখার পক্ষপাতী। বিএনপির মিত্র এ দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সমকালকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব প্রতীক মাথাল। গণসংহতি নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবে। তবে নির্বাচন কমিশনের উচিত কেউ জোটবদ্ধভাবে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে চাইলে সে সুযোগটা রাখা। এই স্বাধীনতাটা রাখা জরুরি।’

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণ-অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সমকালকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত কিনা জানা নেই। তবে যারা একসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই করেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়া উচিত। পরিবর্তনের লক্ষ্যে দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সবাই পরিবর্তন চায়। এজন্য নির্বাচন কমিশন নানাবিধ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে। আমার আশা, কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।’

২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিবন্ধিত জাতীয় পার্টিকে (জাফর) দুটি আসন ছাড়ে বিএনপি। দলটির নেতারা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন। দলটির মহাসচিব সাবেক এমপি আহসান হাবীব লিংকন কুষ্টিয়া-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘আমাদের নিবন্ধন, প্রতীক নেই। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আমরা ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করব।’

জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে ২০০৮ সালে ভোলা-১ এবং ২০১৮ সালে ঢাকা-১৭ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও নিজস্ব প্রতীক গরুর গাড়ি নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব।’ 

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের আরেক শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘‘আরপিওর সংশোধনের খসড়া ইতিবাচক। কিছু বিষয়ে প্রশ্ন আছে। সব আসনেই ‘না’ ভোট রাখা উচিত। নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার বিধানটি ইতিবাচক। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করলে, দল সাইনবোর্ডসর্বস্ব হয়ে যায়। আরপিও চূড়ান্তের আগে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া।’’ 

জোট শরিকের প্রতীক ব্যবহার বন্ধের বিপক্ষে ১২ দলীয় জোট। জোটের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘যদি জোটপ্রধানের প্রতীক ব্যবহার করা না যায় তবে জোট করে লাভ কি? এটির কোনো মানে হয় না।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমর্থন করছেন প্রতীকের নতুন বিধানকে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘নিজের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারলেই ভালো। আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে। এতে নাগরিক ঐক্যের নিজস্ব প্রতীক কেটলি মানুষের কাছে পরিচিতি পাবে।’

এবি পার্টির প্রতীক ঈগল। দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জোটের বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করলে ছোট দল গড়ে উঠতে পারে না। তাই নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতার বিধান ইতিবাচক।