
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আসার সুযোগে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছে দলের একটি অংশ; তাতে নতুন করে ভাঙনের কবলে পড়েছে এইচএম এরশাদের গড়া এ দল।
জি এম কাদেরের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলছেন, আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার কারণে এভাবে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ‘সুযোগ নেই’।
অন্যদিকে মহাসচিবের পদ থেকে বহিস্কৃত মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন, তারা প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই।
ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মো. নুরুল ইসলাম গত ৩১ জুলাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
সেই সঙ্গে জি এম কাদের যে ১০ নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছেন, তাদের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ-পদবি ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন।
ওই ১০ জন হলেন–জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, দপ্তর সম্পাদক-২ এম এ রাজ্জাক খান, প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ (চট্টগ্রাম), নাজমা আকতার (ফেনী), মো. জহিরুল ইসলাম জহির (টাঙ্গাইল), মোস্তফা আল মাহমুদ (জামালপুর), জসীম উদ্দিন (নেত্রকোনা) ও আরিফুর রহমান খান (গাজীপুর)।
এরপর মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক (জিএম কাদের যাকে বহিষ্কার করেছিলেন) এম এ রাজ্জাক খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে পার্টির কো চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার কথা বলা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টি প্রেসিডিয়াম সভায় কো চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
এছাড়া কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, সুনীল শুভ রায়, কাজী মামুনুর রশিদ, নরুল ইসলাম মিলন, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, ইয়াহ ইয়া চৌধুরীসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিনা নোটিসে জি এম কাদের যাদের বহিষ্কার করেছিলেন, সভায় ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে স্ব স্ব পদে পুর্নবহাল করার কথা বলা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে ওই প্রেসিডিয়াম সভায় কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক, চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য এটিইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ,নাসরিন জাহান রত্না, নাজমা আকতার, রানা মোহাম্মদ সোহেল, লিয়াকত হোসেন খোকা, জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, মাসরুর মওলা, জসিম উদ্দিন ভূইয়া, আরিফুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া ফখরুল ইমাম, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ দিদার বখত, একেএম সেলিম ওসমান, নাছির উদ্দিন মাহমুদ, জহিরুল আলম রুবেল, আমিনুল ইসলাম ঝন্টু ভার্চুয়ালি সভায় অংশ নেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
ওই সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতীয় পার্টির জিএম কাদের মনোনীত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমাদের জাতীয় পার্টির কয়েকজন কো চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের প্রাথমিক সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। মহামান্য আদালত যে রায় দিয়েছে, সেখানে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে প্রাথমিক সদস্য পদ ফিরিয়ে দিতে বলা হয়নি। সেই হিসেবে তারা কোনো বৈঠক করতে পারে না, তারা স্পষ্টত আদালত অবমাননা করেছে।
"আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে কয়েকজন একটা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিলে, এই সিদ্ধান্তের কোনো ভিত্তি নেই। এটা আদালত অবমাননা। আর বহিষ্কৃতদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো গুরুত্ব বহন করে না।"
প্রাথমিক সদস্যপদ যাদের নেই, তারা কি প্রেসিডিয়াম সভায় সভাপতিত্ব ও অংশগ্রহণ করতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুজিবুল হক চুন্নু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "তাদেরকে (শামীম পাটোয়ারীসহ জিএম কাদের অংশ) জিজ্ঞাসা করেন, আদালতের রায়টা ভালো করে পড়েছে কি না। আমরা যা করেছি সব আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে করেছি। আমাদের প্রাথমিক সদস্য পদ কেন, সব পদই আছে।"
পূর্বাপর
জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে সম্প্রতি এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিলে জাতীয় পার্টি নতুন করে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে।
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় অনুমতি দেওয়া যাবে না।
এরপর জিএম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। মহাসচিব চুন্নুও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা। সেজন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করেন।
পার্টির কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরকে যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন তালুকদাররা
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সে সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জিএম কাদের ‘একাই সবকিছু’ করতে চান। এর পরিবর্তন চান তারা।
“মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই,” বলেছিলেন তিনি।
জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।
গত ২০ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জিএম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি– সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন। বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জিএম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়।”
এর মধ্যে বিরোধীদের সম্মেলনের পাল্টায় নিজের শক্তির জানান দিতে ২৮ জুন দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহা সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে বসেন জি এম কাদের।
কিন্তু আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওই অংশটি সম্মেলনের নতুন তারিখের ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন।
এক বিবৃতিতে তারা তখন বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই, চেয়ারম্যান যেন অবিলম্বে একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ থেকে সরে এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা পল্লিবন্ধুর (এইচ এম এরশাদ) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।”
জাতীয় পার্টির ওই অংশের একজন নেতা সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পার্টি অফিসে সম্মেলন করার জন্যও তারা প্রশাসনের অনুমতি পাননি। মূলত সে কারণেই তারা অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তারা জি এম কাদেরকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন। দল ভাঙার দায় না নিয়ে তারা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে চান।
দুই পক্ষ এক পা করে পিছু হটায় সে সময় দলের কর্মীদের উত্তেজনা কিছুটা কমলেও এক সপ্তাহের মাথায় জিএম কাদের মহাসচিব পদ থেকে চুন্নুকে সরিয়ে সেই পদে প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে বসান।
সেই সঙ্গে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, চুন্নুসহ ১০ নেতাকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পার্টির ওয়েবসাইট থেকেও তাদের নাম মুছে ফেলা হয়৷
অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা ১০ জুলাই জি এম কাদেরসহ দুইজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় জি এম কাদেরের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আসে।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মত ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে, ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হয়।
কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মত ভাঙ জাতীয় পার্টি।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।