
২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই, এক নির্ঘুম রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেগে উঠেছিল এক অভূতপূর্ব গণবিদ্রোহের ঢেউয়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ দাবি যখন শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে, ঠিক তখনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অবমাননাকর মন্তব্য সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করার পর তাদের বুকে জমে থাকা ক্ষোভ মুহূর্তেই পরিণত হয় গণরোষে।
সেই রাতেই হাজারো শিক্ষার্থী স্লোগান তোলে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। যা কেবল একটি স্লোগান ছিল না, ছিল ১৬ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে এক তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ।
পরের দিন, এই প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্দেশে বর্বর হামলা চালানো হয়। ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারেরা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, রক্তাক্ত করে শত শত তরুণ-তরুণীকে। কিন্তু এই সহিংসতা আন্দোলনকে দমাতে পারেনি, বরং তা হয়ে ওঠে প্রতিরোধের আরও বড় অনুপ্রেরণা।
১৭ জুলাই, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর টিয়ার গ্যাস ও কঠোর দমন-পীড়নের মধ্যেও একদল নারী শিক্ষার্থী বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, পিছু হটেনি। তাদের অটল সাহস আর প্রত্যয় যেন পুরো জাতির চোখে-মুখে সাহস আর প্রেরণা ছড়িয়ে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত এক মহাকাব্যিক গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেয়।
চব্বিশের গণ-আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক উমামা ফাতেমা ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়।
চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী উমামা ফাতেমা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি কবি সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী এবং জৈব রসায়ন ও আণবিক জীববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত।
জুলাই বিপ্লব চলাকালে উমামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে নারীদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
উমামা বিশ্বাস করেন, এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সামনের সারিতে থাকা বিদ্রোহী নারীরা, যারা আন্দোলনকে শুধু সফলই করেননি বরং একে রূপ দিয়েছেন গণজাগরণে। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেন। বিশেষভাবে তুলে ধরেন, কীভাবে নারী শিক্ষার্থীরা সরকারি দমন-পীড়ন, পুলিশের সহিংসতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনি কীভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন?
উমামা ফাতেমা : আন্দোলনের প্রাথমিক সূচনা ঘটে ৫ জুন, ২০২৪। হাইকোর্টের একটি রায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে। সেই রায় প্রত্যাখ্যান করে বিকেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় আন্দোলনের যাত্রা।
আমি তখন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সংগঠনের একজন দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসেবে মনে হয়েছিল, এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া শুধু রাজনৈতিক দায় নয়— এটি ন্যায়ের পক্ষেও অবস্থান নেওয়ার একটি প্রয়োজনীয়তা। আমাদের সংগঠনের অন্য সদস্যদের নিয়ে আমরা আন্দোলনে সম্পূর্ণরূপে অংশগ্রহণ করি।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের পরিধি ও শক্তি বাড়তে থাকে। ৯ জুন রাজু ভাস্কর্যে আয়োজিত কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি তারই প্রমাণ। সেদিনকার মিছিলে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানেই আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিই— নারী শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে আন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ জুলাই থেকে যখন আন্দোলন নতুন গতি পায়, তখন আমরা বিভিন্ন হলের নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করি। প্রথমদিকে আমি নিজেকে ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে এই আন্দোলনে যুক্ত করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিচয় ছাড়িয়ে আমি বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক হয়ে উঠি। বিভিন্ন ফোরামের প্রতিনিধিদের একত্র করে আমি কাজ করেছি একটি যৌথ দাবির পক্ষে— কোটা সংস্কার আন্দোলনের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও মজবুত করার জন্য। তখন আর ব্যক্তিপরিচয় নয়, আন্দোলনের স্বার্থই হয়ে উঠেছিল মুখ্য।
ঢাকা পোস্ট : আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কতটা ছিল বলে আপনি মনে করেন?
উমামা ফাতেমা : এই আন্দোলনের প্রতিটি পর্বেই নারীরা রেখেছেন সাহসিকতার অবিস্মরণীয় ছাপ। শুরু থেকেই তাদের টার্গেট করে দমনচেষ্টা চালানো হয়— যেমনটা ঘটেছিল ১৫ জুলাই। সেদিন ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে নারীদের ওপর হামলা চালায়, যাতে বিক্ষোভকারীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া যায়। তবে, ফল হয়েছিল উল্টো— রক্তাক্ত মুখের সেই নারী শিক্ষার্থীর ছবি সারা দেশে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে এবং বহু মানুষকে আন্দোলনে টেনে আনে।
আমরা দেখেছি, নারী একা দাঁড়িয়ে পুলিশের সামনে প্রতিবাদ করছেন— যখন তাদের সঙ্গীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা দেখেছি, বোনেরা ভাইদের কফিন কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এই দৃশ্যগুলো কেবল প্রতীকী নয়, তারা আন্দোলনের গভীর মানবিকতা ও প্রতিরোধের শক্তিকে তুলে ধরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকরাও নীরব ছিলেন না। তারা শুধু আমাদের সমর্থন করেননি, বরং সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের নৈতিক বৈধতা নিয়েও সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন।
এই আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশগ্রহণকারীই ছিলেন না, তারা ছিলেন নেতৃত্বের কেন্দ্রে। হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের তাড়িয়ে দেওয়া হোক বা আটকে পড়া ভাইদের রাস্তায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে মেয়েরাই প্রথম এগিয়ে এসেছেন। তারা ভিসি চত্বর ও হলপাড়ায় মিছিল করে, সম্মুখভাগে থেকে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন।
আমি এখানে নারী-পুরুষ তুলনায় যাচ্ছি না কিংবা নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বলছি না, আমি শুধু ইতিহাসের সেই সত্যটা তুলে ধরছি যে বিদ্রোহী নারীরাই আন্দোলনের মেরুদণ্ড ছিল। তাদের নেতৃত্ব, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই একটি সফল বিপ্লবে পরিণত হতো না।
ঢাকা পোস্ট : সেই সময় পরিবার বা কাছের মানুষদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
উমামা ফাতেমা : আন্দোলনের সেই সময়টাতে পরিবারের ভূমিকা ছিল খুবই প্রভাবশালী এবং অনেক সময় বাধাস্বরূপও। আমি চেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থেকে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে, কিন্তু পরিবার এসে আমাকে হল থেকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ভাইয়ের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই তারা নানা উপায়ে আমাকে বোঝাতে থাকে যেন আমি আর আন্দোলনে অংশ না নিই। তাদের চেষ্টাগুলোর বেশির ভাগই ছিল আবেগি চাপ এবং ব্ল্যাকমেইল।
তবে, আমি নিজে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই বড় হয়েছি, তখন মনে হচ্ছিল— এটাই তো আমার চাওয়া ছিল। এতদিন ধরে যা বিশ্বাস করে এসেছি, সেই জায়গা থেকে সরে আসা তো নিজের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা। তাই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, থেমে গেলে চলবে না।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ইন্টারনেট বন্ধ করার কারণে আমি তখন অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। একই সঙ্গে পরিবারের মানসিক চাপে টিকে থাকাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। একধরনের নিঃসঙ্গতা ও আতঙ্কে দিন কাটছিল।
আমাকে বিভিন্ন মহল থেকে কল দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসার অফার দিতো। এই অফারকারীদের মধ্যে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার মানুষজন ও সাংবাদিক। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাকে আমার পরিবারকে হুমকি দিয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : কখন বুঝলেন, এই আন্দোলন কেবল দাবি নয় বরং একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিচ্ছে?
উমামা ফাতেমা : ২৫ জুলাই যখন দীর্ঘ সময় পর ইন্টারনেট সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয়, তখন একধরনের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করে। সেই সময়টায় প্রবাসে থাকা অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তারা প্রায়ই আমাদের অনুরোধ করত সরাসরি সরকার পতনের ডাক দিতে। বারবার তারা জানতে চাইত, আপনারা কেন সরকার পতনের কথা বলছেন না?
তাদের উত্তরে আমি ধৈর্য ধরে বোঝানোর চেষ্টা করতাম যে, সেই সময়কার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। শুধু রাস্তায় নামা নয়; পরিবার, নিরাপত্তা, এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকিও আমাদের বিবেচনায় ছিল। ফলে, সরকার পতনের মতো একটি স্পষ্ট আহ্বান দেওয়া তখন এতটা সহজ ছিল না। আমি বরং মনোযোগ দিই আন্দোলনকে নতুনভাবে সংগঠিত করে কৌশলগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার দিকে।
২৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যেই আন্দোলন নতুন করে গতি পায়। তখন দেখা যায়, এই সরকার পতনের দাবি আর কোনো নির্দিষ্ট সংগঠন বা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নয়, এটি জনগণের ভেতর থেকেই উৎসারিত হয়ে উঠছে। এটি কোনো কৃত্রিম প্রচারণা ছিল না, বরং একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও বাস্তব অভিব্যক্তি; একটি অর্গানিক দাবি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন মানুষ সরাসরি বলছিল— ‘নয় দফা নয়, এখন এক দফা!’ সেই ‘এক দফা’ ছিল সরকারের পদত্যাগ। এটি জনগণের কণ্ঠস্বর, আন্দোলনের ভেতরকার স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত।
এই ‘নয় দফা থেকে এক দফায়’ রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তারা ক্রমাগত আমাদের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, মতামত দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন।
অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের পর বাস্তবতা একটি চরম দ্বন্দ্বে গিয়ে দাঁড়ায়— ‘শেখ হাসিনা থাকবে, না আমরা থাকব?’ এই স্পষ্ট বিভাজন, এই বোধ থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন তার স্বরূপ পাল্টায় এবং একসময় তা রূপ নেয় সরাসরি সরকার পতনের আন্দোলনে।
ঢাকা পোস্ট : ৪ আগস্ট ও ৫ আগস্টের সকালটা কেমন ছিল, মনে পড়ে?
উমামা ফাতেমা : ৪ আগস্ট ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনগুলোর একটি। সেদিন রাস্তায় আমি চোখের সামনে লাশ পড়ে থাকতে দেখি। তাদের মধ্যে শাহরিয়ার নাফিসের দেহটিও ছিল। এক রিকশায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, হাত-পা ঝুলে ছিল, মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। চারপাশে শুধু গুলির শব্দ, চিৎকার আর হাহাকার।
একপর্যায়ে আমার পাশেই থাকা একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আর তখনই খবর পাই, ছাত্র ফেডারেশনের শাকিলের মাথায় গুলি লেগেছে। মুহূর্তটি এতটাই অস্থির ও বিভীষিকাময় ছিল যে আমি কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকি— বাঁচার জন্য, সবার জন্য। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি এখন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বাইরের দুনিয়া কিছুই জানতে পারবে না।
পরদিন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই শুনতে পেলাম রাস্তায় নাকি সুনসান নীরবতা। মানুষ বের হতে পারছে না, পুলিশ বাঁধা দিচ্ছে। আমি তখন আমাদের ডিওএইচএসের বাসায়, ফোনে স্ক্রল করে খোঁজ নিচ্ছিলাম রাস্তাঘাটের খবর। দুপুর নাগাদ হঠাৎ টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে একটি খবর— সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সে মুহূর্তেই আমার ভেতরে কিছু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। আমি বুঝে যাই— বড় কিছু ঘটে গেছে। আর আমি বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়।
তখনই দেখি, মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে, ঢেউয়ের মতো জনস্রোত। আমি যখন হাঁটছিলাম, তখন হঠাৎ করেই চারপাশ থেকে মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছিল, কেউ কেউ কণ্ঠ উঁচিয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম, মানুষ আমাকে চিনেছে— আমার সংগ্রাম, আমার অবস্থান তাদের চোখে ধরা দিয়েছে। ওই মুহূর্তটি যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল, একটা দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতিফলনের মতো।
ঢাকা পোস্ট : আন্দোলনের কোন মুহূর্তটি আপনার জীবনে সবচেয়ে তীব্র ও স্মরণীয়?
উমামা ফাতেমা : ২ আগস্ট, জুমার নামাজের পর ঢাকার রাস্তায় যে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলটি গড়ে ওঠে, তা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই মিছিল কেবল ছাত্র আন্দোলনের একটি ধাপ নয়, বরং তা ছিল জনসাধারণের মনে জমে থাকা ক্ষোভ ও প্রত্যাশার বিস্ফোরণ। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই দেখিয়ে দেয়, এই আন্দোলন আর শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি রূপ নিয়েছে একটি গণঅভ্যুত্থানে।
পাশাপাশি, ‘দ্রোহযাত্রা’ ছিল আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়, যা কেবল প্রতিরোধের ভাষা নয়, সাংস্কৃতিক প্রতিচ্ছবি হিসেবেও কাজ করেছে। সাংস্কৃতিককর্মী ও নাট্যকর্মীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তাদের উপস্থিতি ও প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলো সরকার পতনের দাবি আরও বেগবান করে তোলে এবং জনমতকে আরও সুসংগঠিত ও দৃঢ় করে গড়ে তোলে।
ঢাকা পোস্ট : একজন নারী হিসেবে আন্দোলনে নামার সময় কোনো দ্বিধা বা ভীতি কাজ করেছিল কি না?
উমামা ফাতেমা : একজন নারী হিসেবে আন্দোলনের মাঠে নামার সময় শুরুতে দ্বিধা ও ভয়— দুটোই ছিল। পরিবার সবসময়ই আতঙ্কে ছিল, বিশেষ করে যখন পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠেছিল। চারপাশে গুলির শব্দ, সহযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার কিংবা নিখোঁজ হওয়ার খবর— সবকিছু মনের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো, আমি কি পারব টিকে থাকতে?
কিন্তু একইসঙ্গে একটা দায়বোধ কাজ করছিল— এই লড়াই শুধু আমার না, এটা আমাদের সবার। আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল বিশ্বাস। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বললে, আর কখন? সেই বিশ্বাসই আমাকে ভয়ের দেয়াল ভেঙে পথে নামতে সাহস জুগিয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : যে স্বপ্ন বা দাবি নিয়ে জুলাই আন্দোলন হয়েছিল, তার কতটা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?
উমামা ফাতেমা : জুলাই আমাদের যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আজ এক বছর পর দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়— অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই স্বপ্নের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান থেকে যে নতুন পথচলার আশা জন্মেছিল, তা বাস্তবে রূপ দিতে সরকার সম্পূর্ণভাবে সফল হয়নি। বলা চলে, পুরোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনরায় জেঁকে বসেছে সরকারে।
এমনকি আমরা যারা শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম, তার বাস্তবায়নেও আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। এই জুলাই বেঁচে থাকবে কেবল তখনই, যখন তা বাস্তব পরিবর্তনের জন্ম দেবে। যদি আগামী ১০-১৫ বছরে জুলাই কোনো স্থায়ী ও ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা না করতে পারে, তবে তা ইতিহাসে হারিয়ে যাবে। যেমন অনেক সংগ্রাম পেছনে ফিরে গেছে, ঠিক ৭১-এর পরবর্তী হতাশার মতো।
পরিবর্তনের কথা শুধু মুখে বললে চলবে না— প্রয়োজন কার্যকর ও মৌলিক সংস্কার। আমি যে ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দুঃখজনকভাবে, অনেকেই এই প্ল্যাটফর্মকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছে। তাই এ প্রসঙ্গে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা অস্বীকার করা যায় না।
তবে, সবকিছুর পরেও আমি আশাবাদী। এই অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা জনগণই ভবিষ্যতে দেশের প্রকৃত পরিবর্তনের বাহক হবে। কারণ, শেষ পর্যন্ত ইতিহাস গড়ে তারাই যারা নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে জানে।
ঢাকা পোস্ট : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি?
উমামা ফাতেমা : সোজা করে বললে— না। নতুন সরকার আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বরং তারা একটি সুযোগকে নষ্ট করেছে, যেখানে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা।
আমরা আশা করেছিলাম, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর যে পরিবর্তনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্যতা-ভিত্তিক ও গণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের পথে এগিয়ে যাবে। সরকারের দায়িত্ব ছিল সেই শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ বিপরীত। সরকার শুরু থেকেই গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আটকে পড়ে। তারা জনগণের ওপর ভরসা না করে নির্ভর করেছে সচিব, পিএস, এপিএস ও সুবিধাভোগী কিছু রাজনৈতিক দলের ওপর। ফলে গণঅভ্যুত্থান যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও মূল্যবোধ নিয়ে এসেছিল— তা পিছিয়ে পড়েছে।
এর ফলে পুরোনো রাজনীতি, পুরোনো প্রশাসনিক ধারা আরও শক্তিশালী হয়েছে, আর জনগণের আকাঙ্ক্ষা আবারও উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলা যায়, নতুন সরকার বা কাঠামো আমাদের স্বপ্নের প্রতিফলন নয়, বরং একটি বড় ‘মিসড অপরচুনিটি’।
ঢাকা পোস্ট : ‘৫ আগস্টের অভ্যুত্থান’ রাজনৈতিক ইতিহাসে কোন জায়গায় দাঁড়াবে বলে আপনি মনে করেন?
উমামা ফাতেমা : ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে, সেটি কীভাবে মূল্যায়িত হবে— তা নির্ভর করবে অভ্যুত্থানের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ওপর।
আমার দৃষ্টিতে, দিনশেষে যদি আমরা এই অভ্যুত্থানকে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তুলে দিয়ে আসি, যারা পুরোনো ধারা ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যস্ত— তাহলে এটি একটি অমর্যাদাকর সমাপ্তি হিসেবেই ইতিহাসে ঠাঁই পাবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর কিছু ঐতিহাসিক ভুল আমরা করেছি, যা আন্দোলনকে একটি জটিল ও অস্পষ্ট পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ভুলগুলো রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ও দিকনির্দেশনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার।
তবে আমি মনে করি, জুলাই বেঁচে থাকবে তার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যদি আগামী দিনে বাংলাদেশ সেই সংস্কারের স্বপ্নগুলোকে আবারও পুনর্জীবিত করতে পারে, জনগণের মধ্যে সৃষ্ট প্রত্যাশাকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে, তাহলে এই অভ্যুত্থান একটি যুগান্তকারী সামাজিক-রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ইতিহাসে ফিরে আসবে।
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথ যদি কেউ খুঁজে পায়, তাহলে তার ভিত্তি থাকবে এই অভ্যুত্থানেই।