
নুরুল হক নূর। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি। ডাকসুর সাবেক ভিপি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এহ্সান মাহমুদ
আমাদের সময় : গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই এক বছরে কেমন বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছেন?
নুরুল হক : গণ-অভ্যুত্থানের পর যে পরিবর্তনটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে তা হলো, মানুষ ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, মুক্ত-স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে। দীর্ঘ ষোলো বছরের নিপীড়নের পর মানুষ মুক্ত বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছি, সেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
তবে বিগত এগারো মাসে এই সরকারের প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, সেই অনুপাতে অনেকেই হতাশ। ড. ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, দুনিয়াজুড়ে যিনি সমাদৃত- এমন সরকারপ্রধানের কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা, তা আসলে পূরণ হয়নি। সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এগুলোর দৃশ্যমান কোনো উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি। দেশের ৬৪ জেলার হাসপাতালগুলোয় মানুষের চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য হয়নি। সরকারি মন্ত্রণালয়ে মানুষের সেবাপ্রাপ্তি এখনও অনিশ্চিত ও ত্রুটিপূর্ণ রয়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অধিদপ্তরগুলো এখনও দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। এগুলো হলে মানুষ একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে পেত। সুতরাং হতাশা রয়ে গেছে। তবে মানুষ দীর্ঘদিন যে রেজিমের কাছে বন্দি ছিল, সেখান থেকে মুক্তি মিলেছে- এটাই গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আমাদের সময় : ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস ছিল মানুষের ভোটাধিকার না থাকা। বর্তমান বাংলাদেশে যথাসময়ে ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
নুরুল হক : এ ক্ষেত্রে আমি দুটি সংকট দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ গত এগারো মাস বা এক বছরে এই সরকার প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটেনি। সরকার তার সচিবালয়ের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকার আসলে কাদের কথায় চলছে, সরকারের ভেতরে নাকি আরেকটি সরকার রয়েছে- এমন কথাও শোনা যায়। সরকারের কিচেন ক্যাবিনেট কয়টি, তারা কী প্রক্রিয়ায় কাজ করছে, তা দৃশ্যমান নয়। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন যথাসময়ে আয়োজন করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করলেও আরেক সমস্যা। কারণ প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন তিনি উপহার দেবেন। এর কোনো প্রস্তুতি বা বাস্তবতা আমাদের চোখে পড়ছে না। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক দগলগুলো, বিশেষত প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি; তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই দলটিও কতটা শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজের দলকে কন্ট্রোল করতে পারবে, সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাদের দলে এমপি ক্যান্ডিডেট অনেক। প্রতিযোগিতাটা তাই বেশি। এখন দল ও প্রশাসনকে কন্ট্রোল করা তাদের জন্য অনেক বেশি টাফ। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেখানে সরকার দল, প্রশাসন তাদের আসন দখল করে নিয়েছে। সে কারণে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করা যায়নি।
আমাদের সময় : বিএনপি তো এখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেনি। তাহলে তাদের পক্ষে প্রশাসন কন্ট্রোলের বিষয়টি আসছে কেন?
নুরুল হক : এটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়। বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলেও প্রশাসনে তার প্রভাব রয়েছে। আমলারা ‘যেদিকে বৃষ্টি, সেদিকে ছাতা ধরা’র মতো। বিএনপি যেহেতু ক্ষমতায় আসবে, তাই তাদের প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করবেন। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সুনজরে আসার জন্য তারা আগে থেকেই যোগাযোগ রাখতে পারেন, বাড়তি সাপোর্ট দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কা থেকে যায়।
অন্যদিকে ডানপন্থি দলগুলো আলাদা জোট গঠনের কথা ভাবছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। এ অবস্থায় সরকার ও প্রশাসনের শক্তিশালী ভূমিকা না থাকলে আগামী নির্বাচনও সংঘাতপূর্ণ হতে পারে।
আমাদের সময় : ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে একটি অভিযোগ করছেন কেউ কেউ, এটি সময়ক্ষেপণের চেষ্টামাত্র। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুরুল হক : ঐকমত্য কমিশনের একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে আমারও মনে হয়েছে, সময় একটু বেশিই লাগছে। তার পরও এই কমিশন ও সরকারকে আমি সাধুবাদ জানাব যে, তারা একটি অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো মানুষদের নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সহজ কথা নয়। সব রাজনৈতিক দল এ ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়েছে। সবার মধ্যে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা লক্ষ করেছি। অনেকগুলো বিষয়ে দলগুলো একমত হতে পেরেছে, এটা কম কথা নয়।
এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তই বিবেচ্য। তারা যদি অন্তত মৌলিক বিষয়গুলোয় একমত হতে পারে, তাহলে সেটি জাতির জন্য কল্যাণকর। বিশেষ করে সংববিধান, গণপরিষদ, নির্বাচন- এই বিষয়গুলোর সংস্কার জরুরি। সুতরাং এগুলো নিয়ে যদি আমরা একমত হতে পারি, তাহলে বিষয়টি একটি ভিত্তি পাবে। এ ক্ষেত্রে গণভোটের কথাও এসেছে। আমার মনে হয়, নির্বাচনের মাধ্যমেও আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি। যা-ই হোক, যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই নেওয়া উচিত।
আমাদের সময় : প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোটের টাইমলাইন ঘোষণা করেছেন। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে নানা রকম জোটের কথা শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক জোটের রাজনীতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নুরুল হক : ইসলামিক দলগুলোর যে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটা হয়তো শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না। কারণ তাদের মধ্যে আকিদাগত নানা মতবিরোধ রয়েছে। এত মতবিরোধ নিয়ে সব ইসলামিক দল একমত হতে পারবে না। তা ছাড়া বলা হচ্ছে, ইসলামিক দলের ভোটগুলো একই বাক্সে নিয়ে আসা। এটিও একটি বিভাজনমূলক প্রচারণা, যেটি আওয়ামী লীগ আমলে করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের-বিপক্ষের শক্তি’ নামে। এসব ন্যারেটিভ জাতিকে বিভক্ত করে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এখন কেবল ইসলামিক দলকে ভোট দিলেই আমি মুসলমান, না দিলে নয়- বিষয়টি এমন না। তবে ইসলামিক দলগুলো যদি অন্য সব দলের সঙ্গে ঐক্য গড়তে পারে, সে ক্ষেত্রে ভোটের বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারে এবং বিএনপির জন্য সেটি অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কারণ মানুষ এখন সচেতন। প্রযুক্তি সবার হাতে হাতে। সে কারণে বিএনপির বাইরে বড় জোট হলে তাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকেও ভাবতে হবে। পার্লামেন্টে কীভাবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যদি বিএনপি সরকার গঠন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আমাদের সময় : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছেন?
নুরুল হক : আমি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে কোনো অনিশ্চয়তা দেখি না। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই। দেশের প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব প্রতিবন্ধকতা সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। সরকারকেও সাবধানী ও সচেতনভাবে বিষয়গুলো দেখতে হবে। তাদের অতীতের অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর পরিণতির দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে যে, তারা একটি বিশেষ দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত এনসিপিকে তারা নগ্নভাবে সাপোর্ট করছে। এটি একটি নিরপেক্ষ সরকারের চরিত্র হতে পারে না। গোপালগঞ্জের ঘটনাই দেখুন, কীভাবে সরকার তার সব প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে দলটিকে সমর্থন করল। আমি মনে করি, গোপালগঞ্জের ঘটনা অধ্যাপক ইউনূসের সারাজীবনের ক্যারিয়ারে একটি কালিমা লেপন করেছে। এখানে পাঁচজন মানুষ নিহত হলো, হোক তারা আওয়ামী লীগের, তাদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে। শেখ হাসিনার স্টাইলে নির্বিচারে গুলি চালানো হলো। এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা খুব খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য।
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, পরবর্তী সময়ও বিভিন্ন জেলায় এনসিপি সভা-সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছে। সরকারের এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এখন প্রমাণিত সত্য। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এটা নিয়ে অস্বস্তি ও আপত্তির কথা জানিয়েছে। এখন সরকার যদি তার এই আচরণ থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষ হতে না পারে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েই যায়। সে ক্ষেত্রে আরেকটি নির্বাচনী সরকার গঠনের প্রয়োজন পড়বে।
আমাদের সময় : আপনার রাজনৈতিক উত্থান কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তারপর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হলেন। নিজের দল গঠন করলেন। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে শামিল থেকে কারাবরণও করতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মাধ্যমে কেমন দেখতে চান আগামীর বাংলাদেশ?
নুরুল হক : আমিসহ আমার বেশকিছু তরুণ বন্ধু, কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াকালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা একটি দলও গঠন করেছিলাম, যেটি মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থনও পেয়েছে।
যখন কেউ মাঠে নামতে সাহস করেননি, কেউ কথা বলতে পারেননি, লিখতে পারেননি- তখন আমরা আন্দোলন গড়ে তুলেছি। কারণ আমরা নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি, যে বাংলাদেশে নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ থাকবে, সমতা ও মর্যাদা পাবে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই আগামীর বাংলাদেশে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, কর্ম কমিশন- এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীন থাকবে, যাতে মানুষের সেবা ও নাগরিক অধিকার ব্যাহত না হয়। নির্বাচনব্যবস্থা সুষ্ঠু না থাকার ফলে বারবার স্বৈরাচার ফিরে এসেছে। আমরা এমন রাষ্ট্রকাঠামো চাই, যাতে ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরাচার আর কোনোদিন ফিরে না আসে। া