
জুলাই অভ্যুত্থান রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল, তাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে তিন ডজন রাজনৈতিক দলকে সহমতে আনার চেষ্টা চলল সাড়ে পাঁচ মাস ধরে।
শেষ পর্যন্ত আরেক জুলাইয়ে এসে ৮১টির মত প্রস্তাবে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হল। কিন্তু তার সবগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা, বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কতটা সংস্কার হবে, যেসব কারণে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে, তার সমাধান মিলবে কি না––এসব প্রশ্ন থেকেই গেল।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী প্রশ্নে আলোচনায় এতগুলো দলের অংশগ্রহণ দেশের আইনসভাও কখনো দেখেনি। সেই জায়গা থেকে অধিকাংশ দলকে এক টেবিলে এনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাকে ‘সাফল্য’ হিসেবেই দেখতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এস এম আলী রেজা।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন এ বিষয়ে একমত নন।
তার মতে, রাষ্ট্র সংস্কার বলতে যেসব মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন বোঝায়, এত দল নিয়ে আলোচনা করে সেসব জায়গায় ঐকমত্যে পৌঁছানোর সুযোগই ছিল না। ফলে সংলাপে ‘আড়ম্বর’ যতটা হয়েছে, সাফল্য ‘ততটা আসেনি’।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ অবশ্য নিজেদের ‘সফল’ বলেই মনে করছেন। বৃহস্পতিবার রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার সমাপ্তি টেনে তিনি বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।”
৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদের আলোচনা শেষ করতে চাওয়ার চেষ্টা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সেটাতে সফল হয়েছি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার কারণে।”
তিনি জানান, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক দলগুলো যখন একমত হতে পারেনি, কিংবা সুনির্দিষ্টভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তখন কমিশনের কাছে দায়িত্ব দিয়েছে। কমিশন তারপরও আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সংশোধিত প্রস্তাব হাজির করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো সকলের মতামত নিয়ে গৃহীত হয়েছে।
“এই আলোচনার মধ্য দিয়ে যে সমস্ত বিষয়ে ঐক্যমত তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবগুলো প্রতিদিনই আমরা দিয়েছি। আজকে বেশ কয়েকটি বিষয় হয়েছে। আমরা আগামীকালের (শুক্রবারের) মধ্যে সেগুলির বিস্তারিত অবশ্যই আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
আলী রীয়াজ বলেন, “আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা হচ্ছে যে রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছেন। ভিন্ন মতের মধ্য দিয়ে গেছেন। তারপরেও তারা এক জায়গায় এসেছেন।
“ক্ষেত্রবিশেষে নোট অফ ডিসেন্স থাকলেও আমরা যেটা দেখতে পেয়েছি, সেটা হচ্ছে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রচেষ্টা সকলেরই ছিল।”
তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে জাতীয় সনদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত পাওয়া গেছে। সেগুলোকে সমন্বিত করে পরিবর্তন পরিবর্ধন ইত্যাদি করে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেব।”
আলোচনা যেখানে থামল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়।
গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতায় এসে আবার যেন কেউ কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে না পারে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অবিচার, দুঃশাসন আর বৈষম্যের যেন অবসান হয়, সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির হাত থেকে যেন মানুষের মুক্তি মেলে, বাংলাদেশ যাতে সত্যিকার অর্থে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে যেতে পারে, সেজন্য সংবিধান আর শাসন পদ্ধতিতে বড় ধরনের সংস্কারের দাবি সামনে আসে।
মোটাদাগে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য ছিল, মৌলিক ওই সংস্কারগুলো না হলে কেবল নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন ঘটবে না।
সেই দাবি পূরণে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দলগুলোর মধ্যে ৩৩টি তাদের মতামত দেয়।
এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের সংলাপ শেষ করে কমিশন। তাতে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার কথা সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে তালিকা দিয়ে জানানো হয়।
• প্রথম পর্বে ৬২ বিষয়ে ‘ঐকমত্যে’ পৌঁছার তালিকা দিল কমিশন
যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা ছিল, সেসব বিষয়ে নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ২৩ দিন প্রায় ত্রিশটি দলকে নিয়ে একসঙ্গে বসে দশটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ মোট ১৯টি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে কমিশন।
ঐকমত্য যেসব বিষয়ে
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নির্ধারণ
৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান
৫. উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ
৬. পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর
৭. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা
৮. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
৯. নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি
১০. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার
১১. প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি নয়
১২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
১৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব
১৪.সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন
১৫. সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত;
১৬. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি;
১৭. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব;
১৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি।
১৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পদ্ধতি
নোট অব ডিসেন্ট যেসব বিষয়ে
ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর ’ভিন্ন মতের’ (নোট অব ডিসেন্ট) এর কথা তুলে ধরে শেষ দিনের বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, “নারীদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট এসেছে৷ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে আজ (বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ-মার্কসবাদী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি নোট অব ডিসেন্ট প্রদানসহ সভা বর্জন করে। এছাড়া এ বিষয়ে গণফোরামের প্রতিনিধি এই বিষয়ে ভিন্নমত প্রদান করলেও সভা বর্জন করেননি।”
কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টসহ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ সংস্কার সিদ্ধান্তগুলো হল-
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
২. নারী প্রতিনিধিত্ব
৩. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রীম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ
৪. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা
৫. সরকারি কর্মকমিশন, দুদক, সিঅ্যান্ডএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা
৬. উচ্চকক্ষ গঠন
৭. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি
৮. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব
৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বরের প্রস্তাবসমূহ
১০. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
বাস্তবায়ন কীভাবে
ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারই বাস্তবায়ন করতে পারবে। বাকি বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে পাস করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়া হবে জুলাই জাতীয় সনদের মাধ্যমে।
সংস্কার প্রস্তাবের আলোচনার মধ্যেই জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া প্রস্তুত করেছে ঐকমত্য কমিশন। যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, নির্বাচনের পর দুই বছরের মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেখানে।
জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির পটভূমি, ঐকমত্য কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম তুলে ধরার পাশাপাশি ঐকমত্য হওয়া প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো যুক্ত করা হবে এই সনদে।
খসড়া চূড়ান্ত করে তাতে রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রতিনিধিদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সদস্যদের সই নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার রাতে সংলাপের ইতি টেনে ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে দলগুলোর কাছে খসড়া তুলে ধরে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করা হবে।
“কয়েকদিনের মধ্যে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর (সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ) কাছে পৌঁছে দেব এবং তারই ভিত্তিতে আমরা আশা করছি যে জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আমরা অগ্রসর হতে পারব।”
আলী রীয়াজ জানান, বাস্তবায়নের পথ কী হবে সেগুলো নিয়েও বিভিন্নভাবে আলোচনা হবে।
“সেই আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা মনে করি যে কোনো প্রক্রিয়াতে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ, পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। সেই প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে, আন্তরিকতা আছে।
“আমরা অনুরোধ করেছি যে তারা নিজেদের মধ্যেও আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখুন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করব। এর বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন, অর্থাৎ সকলকে সমন্বিত করে সকলের সাথে এ বিষয়ে পথ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ আলোচনায় আমরা অংশ নেব।”
তার আগে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার কাজটি করা হবে জানিয়ে কমিশনের সহ সভাপতি বলেন, “আগামী কয়েকদিন ধরে আমরা সেই কাজটাই করব। যে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার পরে সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা পৌঁছে দেব। তাদের কিছু যদি মতামত থাকে, সেগুলো যদি সংশোধন করতে হয়, সেগুলো আমরা করব এবং তারপরেই কেবলমাত্র এটি বাস্তবায়ন বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।”
‘অর্জন অনেক, দরকার ছিল আরো আলোচনা’
অধ্যাপক এস এম আলী রেজা মনে করেন, এতগুলো রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় এনে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারাই ঐকমত্য কমিশনের বড় প্রাপ্তি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে তিনি বলেন, “ডায়লগকে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে চাই এবং স্টেকহোল্ডারদের সাথে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে মোটা দাগে এনগেজ করা। এ পর্যন্ত ঐকমত্যের এ অর্জনটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।”
ঐকমত্য কমিশনকে কেন সফল বলছেন, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, “শুরুতে তো অনেক বিষয়ে ভিন্নমত ছিল। পরে দেখুন ডায়লগের মাধ্যমে ডিফারেন্সগুলো আস্তে আস্তে কমে এসেছে। আমার মনে হয়, এখন যে বিষয়গুলোতে মতানৈক্য আছে, আরো কিছু সময় পেলে, আরো আলোচনা হলে সেখানেও ঐকমত্য হয়ে যেত।”
অধ্যাপক রেজা বলেন, “সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে বোধহয় ডেডলাইন জুলাই। আমি মনে করি, তত্ত্বাবধয়ক সরকার, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোটা দাগে একটা ঐক্যে পৌঁছানোর জন্য যদি জুলাই ঘোষণা, সনদ–এসব একটু পেছানো হত,; স্টেকহোল্ডারদের আরো এনগেজ করে (সার্বিক বিষয়ে) একটা ঐক্যে পৌঁছানো সম্ভব ছিল বলে আমি মনে করি।”
তবে কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারের বিষগুলো ‘আরো বিবেচনাপ্রসূত হওয়া দরকার ছিল’ বলে তিনি মনে করেন।
“এডুকেশন কমিশন নামে কিন্তু কোনো কমিশন নেই। স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রতিবেদনও আমলে নিয়ে কাজ করা দরকার ছিল।”
‘যত আড়ম্বর, তত সাফল্য নেই’
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, সংবিধানের মূলনীতির মত বিষয় সংস্কারের প্রশ্ন যখন আসে, সেখানে সব দলের একমত হওয়ার ‘সুযোগ নেই’। ফলে সংস্কার প্রশ্নে খুব বেশি সাফল্যের আশাও তিনি করেন না।
“আমার কাছে মনে হয়েছে- এটার আড়ম্বর বেশি, এটার আওয়াজ বেশি। এটা সরকার চাচ্ছে। কিন্তু আদৌ মানুষ চাচ্ছে কিনা, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারব না।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে মতানৈক্যের প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, “ঐকমত্য কমিশন যদি চায় যে তারা যে প্রস্তাব দিয়েছে, সবগুলো রাজনৈতিক দল তাতে হ্যাঁ, হ্যাঁ করবে, সেটা তো হবে না। আমি মনে করি ঐকমত্যে পৌঁছাতে এখানে এক ধরনের প্রেশার তৈরি করা হয়েছে।”
যত বড় আয়োজন, সেই তুলনায় সাফল্য ততটা নেই মন্তব্য করে এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা যে রাজনীতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের সকল মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করবে কিনা, সেটাও তো বলা মুশকিল।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে প্রক্রিয়ায় এই ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা বলছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জোবাইদা নাসরীনের।
তিনি বলেন, “বেশিরভাগ সংস্কার কমিশন কিন্তু রুট লেভেলে যায়নি। আমি দুই তিনটা কমিশনের কথা বলব, যারা ২২টা ওয়ার্কশপ করেছে, ঢাকার মধ্যে করেছে ৮টা।
“সংস্কার কমিশনগুলো মানুষের মতামত শুনেছে, মানুষের কাছে গিয়েছে, মানুষের মতামত নিয়েছে কি না, সেই প্রক্রিয়াটা নিয়ে এক ধরনের সংশয় রয়েছে। সুতরাং এই ঐক্যমতের যে সুপারিশগুলো, সেগুলো আদৌ বাংলাদেশের মানুষের সুপারিশ কিনা, এ বিষয়ে আমি সংশয় রাখছি।”
‘ভুল, শুধু ভুল’
রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার অবশ্য শুরু থেকেই ঐকমত্যের সংলাপের বিরোধিতা করে আসছেন। সংবিধান সংস্কার নয়, তিনি নতুন সংবিধান লেখার পক্ষে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারণাটাই ভুল। গণঐক্য ছিল। গণঅভ্যুত্থানটা হয়েছে গণঐক্যের ভিত্তিতে। গণঅভ্যুত্থানকে নষ্ট করার জন্য জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়েছে। এটাই আমি বারবার বলেছি।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “সরকারের উচিত ছিল জনগণের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের সঙ্গে কথা বলার খুব সিম্পল পদ্ধতি হল- উপজেলার আছে, জেলা আছে, বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান আছে। বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম ছোট সভা বড় সভা, সমাবেশের মধ্য দিয়ে জনগণকে জিজ্ঞাসা করা- এই গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে, এখন কী ধরনের রাষ্ট্র তারা চায়।”
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, “কোনো ব্যক্তির অধিকার এবং ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়– এমন কোনো রাষ্ট্র জনগণ চায় না। এমন কোনো সংবিধান বা এমন কোনো গঠনতন্ত্র থাকুক, এটা তারা চায় না। এটা হল এক নম্বর।
“দুই নম্বরটা হল- প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস হয় এমন কোনো আইন কিংবা নীতি রাষ্ট্র চায় না।
“তিন নম্বর হল, জনগণের কর্মসংস্থান, তাদের জীবন এবং জীবিকা ধ্বংস হয়– এমন কোনো নীতি বা আইন জনগণ চায় না।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “এই তিনটি নীতির ভিত্তিতে একটা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। বা এ তিন নীতির সঙ্গে বর্তমান সংবিধান সাংঘর্ষিক হলে, তাহলে তা বদলাতে হবে। সিম্পল! কিন্তু আমাদের ক্ষমতায় যারা আছে, তারা এটা উপেক্ষা করেছে।”
এই কলামিস্টের ভাষায়, “রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসাটাই ছিল গণবিরোধী। রাজনৈতিক দলগুলো তো গণঅভ্যুত্থান করেনি। গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।
“খুব সহজে জনগণকে আবার রিঅরগানাইজ করা যেত। জাতীয় ঐকমত্য কথাটাই তো ক্ষতিকর; এটা তো গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে।”
আইনি ভিত্তির বিতর্ক
রাষ্ট্র সংস্কারের ১৯টি মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য পৌঁছানোর কথা বলা হলেও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদে সই নেওয়া নিয়ে নতুন জটিলতায় পড়েছে ঐক্যমত্য কমিশন।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে সই করবে কিনা, সেটা তারা ভেবে দেখবে।
আবার শেষ দিনের বৈঠকে সিপিবি, বাসদসহ চার দল জাতীয় চার নীতি বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে বৈঠক বর্জন করে বলেছে, জুলাই সনদে সই করার সম্ভাবনা নেই।
আর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কার প্রস্তাবের আইনি ভিত্তি দেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তুলেছে। এ স্বীকৃতি ছাড়া জুলাই সনদে সই না করার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তারা। এমনকি সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও এসেছে জামায়াতের পক্ষ থেকে।
বিএনপি এ সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে বললেও সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, "জুলাই সনদে যদি আইনি ভিত্তি দেওয়া না হয় এবং এখন থেকে এটা বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আমরা যত জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, সেগুলোর কোনো প্রতিফলন ঘটবে না। এটাই আজকে আমাদের মূল ইস্যু।
“আমরা বলছি যে, এটার কতগুলো অল্টারনেটিভ আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য এখানে আছে। এর ভিতরে আমি রিপিট করি আবার বলেছিলাম আপনাদের কাছে যে লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক যেটা ভালো লাগে।
"আমাদের মূল কথা হচ্ছে, এটাকে লিগালাইজ করতে হবে; আইনি মর্যাদা দিতে হবে এবং সেই মর্যাদার ভিত্তিতে এখন থেকেই ঐক্যমতের বিষয়গুলো মাঠে কার্যকর থাকবে।"
তিনি বলেন, "গভর্মেন্ট এখানে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য আন্তরিকতার পরিচয় দেবে এবং সে হিসেবেই তারা উদ্যোগ নেবে। আর আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো গড়িমসি হয়, তাহলে বোঝা যাবে, এর ভেতরে 'কুচ কালা হ্যায়'।”
জামায়াতের এ নেতা বলেন, “সংস্কারকে বিলম্বিত করা, সংস্কারকে আইনি ভিত্তি না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা, এটা আমাদের সুষ্ঠ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ষড়যন্ত্র কিনা, সে ব্যাপারেও আজ আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
“আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, যারা যত দেরি করবে সংস্কারকে এখানে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য, তারাই মূলত নির্বাচনকে অনিশ্চিত করার জন্য দায়ী থাকবে।”
তাহের বলেন, "সংস্কারকে লিগালাইজ করার জন্য সরকারের আইনগতভাবে যেটা করা দরকার, সেটা করে ৫ (অগাস্ট) তারিখে এটা ডিক্লারেশন দেবে। তাহলে দেখা যাবে, দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। যারা পানি ঘোলা করতে চায় তারা সে সুখ পাবে না।"
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আবারও বসতে হবে। (সংসদ নির্বাচনের) দুই বছরের মধ্যে হলে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। দ্রুত এটি কার্যকর করতে হবে।
তিনি বলেন, "আইনি ভিত্তি না দিলে, এই সনদ একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই থাকবে। এমনটি হলে আমরা সই করব না। কারণ পরবর্তী সরকার এর স্বীকৃতি দেবে, এমন কথা ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।"
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “শুধু কমিশন নয়, এই সনদে সব রাজনৈতিক দল সই করবে। এটি একটি জাতীয় ঐকমত্য।
“এটি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়। এটি আইনের চেয়েও বড়। জনগণের এ প্রত্যাশা (সংসদের মাধ্যমে) সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করার অঙ্গীকার আমরা করেছি।”
সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এদিন বৈঠক ‘বর্জন’ করে বাম ধারার চার দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং বাসদ মার্কসবাদী।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “আমরা এই সভা বর্জন করেছি। এইটা যদি বহাল রাখে, এই যে জুলাই সনদ, সেই সনদে আমরা স্বাক্ষর করতে পারবো কিনা, সেটা আমাদের থেকে ভেবে দেখতে হবে।
“আমরা দলীয় ফোরামে সেটা আলোচনা করব; অসম্ভব হয়ে গেছে। এইটা রাখার পরে আমরা সনদে স্বই করতে পারব না।”
‘চাপে থাকবে আগামী সরকার’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান এখন রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সনদে সই করলেও নির্বাচনের পর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে।
“এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর করার জন্য যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, যেমন অধ্যাদেশ অথবা পরবর্তী সংসদে পাস, এ ব্যাপারে তো দুই পক্ষের দুই রকম মতামত আছে। ঐকমত্য হলেও এক্ষেত্রে একটা প্রবলেম থেকে যাবে। অধ্যাদেশ জারি করলেও তো পরবর্তী সংসদে অনুমোদন করাতে হবে।”
সংস্কারের মাধ্যমে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এগিয়ে গেছে মন্তব্য করে এ শিক্ষক বলেন, “বাংলাদেশে এখন এ ধরনের ঐকমত্য হোক বা না হোক- দুটো ক্ষেত্রেই যারা ক্ষমতায় আসবে একটা চাপে থাকবে। রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করার সেই চাপটা কেউ ইগনোর করতে পারবে না।”
যতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ‘একধাপ’ অগ্রগতি হবে মন্তব্য করে মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা বারবার শুরু করি, এটাই সমস্যা। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একটা সামাজিক চর্চা তৈরি হল, সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করার, শাসনকে পরিবর্তন করার চাপ তৈরি হয়েছে। একটা পরিবর্তন দরকার, সমাজ তা শুনেছে। এটাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”