
শেখ ফজলে নূর তাপস সব সময় এতিম সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেন। ছোটবেলায় বাবা-মা হারানোর কারণে তাঁর প্রতি সবার ছিল আলাদা স্নেহ। কিন্তু সেই স্নেহ পুঁজি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন মহাদুর্নীতিবাজ। শুধু দুর্নীতির মধ্যেই তাঁর অন্ধকার জগৎ সীমাবদ্ধ রাখেননি। ধীরে ধীরে দুর্নীতির হাত চারদিকে বিস্তৃত করেছেন। একসময় হয়ে উঠেছিলেন দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার। যেহেতু আইন পেশার আড়ালে তাপস জামিনবাণিজ্য করতেন, সেজন্য আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সবাই তাপসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। এ যোগাযোগের সূত্র ধরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একসময় এ আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁর চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। কিন্তু তাপস যখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হন, তখন থেকে আস্তে আস্তে নিজের চাচাকে হটিয়ে তিনি হতে থাকেন অপরাধীদের গডফাদার। এ মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। এসব অবৈধ অর্থ আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সে সময় আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্রাট, খালেদসহ বেশ কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসীকে সে সময় আটক করা হয়েছিল। সেই গ্রেপ্তারের ব্যাপারে নেপথ্যে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বতেই এ অভিযান চালানো হয়েছিল। সম্রাট-খালেদ এঁরা সবাই ছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নিয়ন্ত্রণে। শেখ সেলিমের নির্দেশেই তাঁরা অস্ত্র, মাদকসহ অবৈধ ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখানে তাপস হস্তক্ষেপ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাপস শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। সেখানেই তৎকালীন যুবলীগের একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো বন্ধের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। আর এসবের নেপথ্য ছিলেন তাপস। শেখ সেলিমের সঙ্গে শেখ হাসিনার দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে সম্রাট-খালেদের মতো পথের কাঁটাদের সরিয়ে দেন। যাঁরা তাঁর অনুগত নন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেন। এমনকি তাঁর নিজের ফুপা ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে হটিয়ে তাঁর বড় ভাই শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান করেন। পরে অবশ্য শেখ পরশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো থাকেনি। পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথীর সঙ্গে হাই কোর্ট নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। যুথী যখন যুবলীগের চেয়ারম্যানের স্ত্রী, এ পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন রকম বাণিজ্য এবং লুটপাট শুরু করেছিলেন, তখন তাপস ঈর্ষান্বিত হন। কারণ যুথী এভাবে চাঁদাবাজি এবং যুবলীগ নিয়ন্ত্রণ করবেন এটা তাপসের পছন্দ হয়নি। তখন তিনি যুথীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং যুথীকে সুপ্রিম কোর্টে কোণঠাসা করে ফেলেন। অন্যদিকে পরশের কমিটিবাণিজ্যসহ বিভিন্ন চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য তৎপরতা চালান। যুবলীগের বিভিন্ন নেতাকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি শুরু করেন। এ সময় দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য হয়েছিল। এ বিরোধের আসল কারণ ছিল অবৈধ এবং লুটপাটের অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা। তবে তাপস পরশের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
তাপসের ল চেম্বারের ফাইল অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হেলাল, জিসান ওরফে চিটার জিসান, সুব্রত বাইন, বিকাশ, প্রকাশ, কিলার আব্বাস, তাজ, ফ্রিডম, টিটন, মোল্লা মাসুদ এদের প্রত্যেকের আইনজীবী হিসেবে ছিল শেখ তাপসের ফার্ম। বিকাশ ছিল ভয়ংকর সন্ত্রাসী এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্রিয়াশীল শীর্ষ সন্ত্রাসী। এ বিকাশের জামিন করান তাপস। হাই কোর্টে অভিনব কায়দায় এ জামিন করানো হয়। এ জামিন নিয়ে সারা দেশে হইচই হয়। পরে আপিল বিভাগ এ জামিন বাতিল করে দেন। এরপর তাপস তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে বিকাশের জন্য ক্ষমা মঞ্জুর করান। সে ক্ষমার আদেশে বিকাশ মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
আসলামের জামিনের সমস্ত প্রক্রিয়া তাপসের ল ফার্ম থেকে সম্পন্ন হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর আসলাম কারাগার থেকে মুক্ত হন। এ ছাড়া পিচ্চি হেলালের আইনজীবী হিসেবে তার জামিনের আবেদন এবং মামলাগুলো দেখভালের দায়িত্ব ছিল তাঁর। এর ফলে দুটি ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত এসব আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আস্তে আস্তে তাপসের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। তাদের মাধ্যমে ঢাকা শহরে অপরাধীদের গডফাদারে পরিণত হয়েছিলেন তাপস। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ আমলে সম্রাট এবং খালেদের নেতৃত্বে যে অন্ধকার জগৎ তৈরি হয়েছিল, সে জগৎ তছনছ করে দিয়েছিলেন তাপস। সম্রাট-খালেদকে হটিয়ে নতুন আন্ডারওয়ার্ল্ড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাপস হয়ে উঠেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার। আর তাপসের প্রতি সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতা না দেখানোর কারণে শীর্ষ সন্ত্রাসী সম্রাট-খালেদদের কারান্তরিন হতে হয়েছিল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাপসের কাছে যদি আন্ডারওয়ার্ল্ড আত্মসমর্পণ করত, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করত না, বরং নানানরকম পৃষ্ঠপোষকতা করত। আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটা নতুন বিন্যাস তৈরি করেছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তাদের সবাইকে তাপসের লোক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
সিটি করপোরেশনের বাইরে তাপস দৈনিক বাংলার বাণীতে নিয়মিত বসতেন। বাংলার বাণী কার্যালয়ে এসব সন্ত্রাসীর লোকজনকে নিয়মিত দেখা যেত। বিভিন্ন ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং হত্যা মামলায় যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করত, কারও বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করত তখনই তাপসের ল চেম্বার থেকে তাদের জামিনের প্রক্রিয়া শুরু হতো। তা ছাড়া তাপস নিজেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টেলিফোন করতেন। টেলিফোন করে তাদের জামিন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। এভাবেই তাপস আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিলেন অপরাধীদের গডফাদার। যিনি জীবন শুরু করেছিলেন তীব্র অভাব-অনটনে, মাঝে মাঝে স্কুলে বেতন দিতে পারতেন না, সেই তাপস আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠেন, ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন সবার কাছে একটি লক্ষ্মী ছেলের মতো। সবাই তাঁকে মনে করত একজন ভদ্র তরুণের প্রতীক। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভ এবং পারিবারিক প্রভাবে তিনি আস্তে আস্তে ভয়ংকর দানবে পরিণত হয়েছিলেন। যে দানব বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা তছনছ করে দিয়েছিলেন, নিজে হয়েছিলেন দুর্নীতিদের সর্দার এবং অপরাধ জগতের গডফাদার। ক্ষমতার দাপট এবং বলয়ে থেকে একজন সাদাসিধে, সহজসরল ব্যক্তি কীভাবে হিংস্র দানব হয়ে ওঠেন, তার বড় উদাহরণ শেখ ফজলে নূর তাপস। গত ১৫ বছরে তাপস হয় উঠেছিলেন অপরাধীদের ‘ডন’।