Image description

নাটোরের মাটিতে রাজত্ব ছিল জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের। দু-একবার শাসন করেছে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিরা। এর মাঝে দেড় দশক ভোটাধিকারই কেড়ে নিয়েছিল ফ্যাসিবাদীরা। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে জুলাই বিপ্লব ফিরিয়ে এনেছে ভোটের সেই সুদিন, আর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তৈরি হচ্ছে উৎসবের আমেজ। এরই মধ্যে উত্তরের এই জেলার অধিকাংশ আসনে জনপ্রিয় ও হেভিওয়েট নেতারা প্রচারণামূলক কার্যক্রম শুরু করায় জনমনে দেখা যাচ্ছে উচ্ছ্বাস।

জেলার সাত উপজেলা নিয়ে গঠিত চারটি আসন। এসব আসনে আগামী নির্বাচন উপলক্ষে নিজের অবস্থান তৈরি করছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তারা নানা কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দুয়ারে যাওয়ায় নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে জনগণের। একই সঙ্গে পছন্দের নেতাকে সমর্থন দিয়ে জনসেবা করার সুযোগ দিতে স্বপ্ন বুনছে সাধারণ মানুষ। ইসলামী আন্দোলন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অস্তিত্বের জানান দিলেও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি। আর তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ পার্টিরও (এবি পার্টি) রয়েছে ঢিলেঢালা কার্যক্রম।

নাটোর-১ (লালপুর ও বাগাতিপাড়া)

এ আসনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থি ভোটার বেশি হওয়ায় বেশ কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। এবার দলটির টিকিট চাইছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শক কমিটির বিশেষ সহকারী, বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও নাটোর জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী তাইফুল ইসলাম টিপু এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান পটলের ছেলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি, লালপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এবং বর্তমান জেলা শাখার সদস্য ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজন।

জামায়াত এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিকে প্রার্থী দিয়েছে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন। লালপুর উপজেলা শাখার আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে মনোনয়ন দেওয়ায় প্রচারে বেশ সাড়া ফেলেছেন তিনি। নানা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনি এলাকার সব পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন আজাদ। তিনি বলেন, জনগণ তাকে বিজয়ী করলে এলাকার কেউ আর বঞ্চিত বা বৈষ্যমের শিকার হবে না।

এবি পার্টি থেকে এখানে প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন দলের জেলা কমিটির সদস্য সচিব এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যাংকিং ও বেসরকারি খাতবিষয়ক সহ-সম্পাদক এ এস এম মোকাররেবুর রহমান নাসিম। তবে অন্য কোনো দলের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা)

জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শিল্পপতি আবুল কাশেম নানা কর্মসূচি নিয়ে সরব থাকলেও নেতাকর্মীদের মধ্যে তার অনুসারী খুবই কম। তবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য, সাবেক উপমন্ত্রী, বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুই শেষ কথা। তিনি এবারো দলটির টিকিট প্রত্যাশী।

দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দেড় দশক এ আসনের মানুষ উন্নয়নবঞ্চিত। তারা দুলুর দিকে চেয়ে আছেন। আবার তিনি নির্বাচিত হলে মন্ত্রিত্ব পাবেন, এলাকায় উত্তরোত্তর উন্নয়ন করবেন। এ জন্য তার পক্ষে নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটাররা একজোট হচ্ছেন।

জামায়াত দলটির জেলা শাখার নায়েবে আমির ও বাগতিপাড়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস আলীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এতে প্রচারে নানা সুবিধা পাচ্ছেন তিনি। আগে থেকেই জনপ্রিয় নেতা হওয়ায় বিএনপির যে কোনো প্রার্থীকে তার সামনে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন।

জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক ড. মীর মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর কাছে সামান্য ভোটে পরাজিত হয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন অধ্যাপক ইউনুস। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় এবারো তিনি চ্যালেঞ্জিং প্রার্থী। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হলে তার জয়ের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

নাটোর-৩ (সিংড়া)

বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে দলটির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও তিন বারের এমপি নির্বাচিত হন অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ। তার মতো হেভিওয়েট মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও দলটির টিকিট চান নবীন-প্রবীণ আরো সাত নেতা। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছেন।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেনÑ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ পাওয়া তরুণ ও ত্যাগী নেতা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিংড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দাউদার মাহমুদ, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সিংড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আলোয়ারুল ইসলাম আনু, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সিংড়া থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার ইউসুফ আলী, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীন এবং গবেষক কাজী খায়রুল বাসার। এছাড়া আরো কয়েকজন নানাভাবে কেন্দ্রে তদবির করছেন বলে জানা গেছে।

জামায়াত এখানে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইদুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির জেলা সেক্রেটারি অধ্যাপক সাদেকুর রহমান বলেন, ১৯৯১ সালে জামায়াতের প্রার্থী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিংড়া থেকে জয়ী হয়েছিলেন। আশা করি এবারো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সিংড়ার সর্বস্তরের জনগণ জামায়াত মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করবেন।

নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর)

সারা বছর দলের বড় নেতাদের ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ তেমন পান না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অনেকটা যেচে কর্মী, সমর্থক, অনুসারীসহ সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও। এতে উজ্জীবিত হচ্ছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ আসনে ভোটারদের মন জয় করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন জেলা বিএনপির এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক নেতা আবদুল আজিজ ও জেলা জামায়াতের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা আবদুল হাকিম।

এই দুই নেতা ভিন্ন দল ও আদর্শের হলেও তাদের তৎপরতা প্রায় অভিন্ন। তারা দীর্ঘদিন ধরে খবর পেলেই দুই উপজেলার যে কোনো মানুষের জানাজায় হাজির হচ্ছেন, সুখে-দুঃখে দাঁড়াচ্ছেন পাশে। তাদের কাছে পেয়ে ভরসা পাচ্ছেন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।

তবে আবদুল আজিজ ছাড়া এখানে বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন দলটির সাবেক এমপি প্রয়াত মোজাম্মেল হকের ছেলে জেলা শাখার সদস্য ব্যারিস্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জু ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক জন গমেজ।

জামায়াত প্রার্থী অধ্যাপক হাকিম বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। বেশ কিছুদিন তিনি উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। তাকে জনগণ বিপুল সমর্থনে জয়ী করবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস নেতাকর্মীদের।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রহিম নেওয়াজ আমার দেশকে বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপি যাকে ধানের শীষ দেবে তার জন্যই সব নেতাকর্মী ভোটের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক ড. মীর মো. নূরুল ইসলাম বলেন, জনগণ চাইছে সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত ও চাঁদাবাজমুক্ত প্রার্থী, যেসব গুণ একমাত্র জামায়াত নেতাদের মধ্যেই আছে। তাই আগামী নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদের জয়ের ব্যাপারে সবাই আশাবাদী।

তরুণ ভোটার মাহমুদুল হক মাহী বলেন, ‘হাজারো ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। ভোটের মাধ্যমে যেন নতুন ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় না আসে সেটা খেয়াল করছি। জীবনের প্রথম ভোট কোনো দেশ বিরোধীকে নয়, দেশপ্রেমিক প্রার্থীকে দিতে চাই।’ প্রবীণ ভোটার প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ভোট দিতে পারিনি। আমি যে ভোটার সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। জুলাই বিপ্লবের কল্যাণে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই মূল্যবান সমর্থন সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে দিতে ভুল করব না।’

নির্বাচন বিশ্লেষক নাটোর সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক আবদুর রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার সৌন্দর্য হলো বহু দলের অংশগ্রহণ। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে এবার পরিবর্তিত পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ পেলে ভোটাররাও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচনে ভুল করবে না।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন লালপুর উপজেলা প্রতিনিধি এ কে আজাদ সেন্টু, বড়াইগ্রাম উপজেলা প্রতিনিধি হাসানুল বান্না উজ্জল, গুরুদাসপুর উপজেলা প্রতিনিধি রহমত আলী, বাগাতিপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির ও নলডাঙ্গা উপজেলা প্রতিনিধি আসলাম সরদার]