
রাজধানীর বাইরে তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বেকায়দায়। কোনো কোনো ঘটনা বিএনপিকে অস্বস্তি ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। স্থানীয় প্রশাসনও অনেক ক্ষেত্রে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে। দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মারামারি হচ্ছে। এতে দলটির নেতাকর্মীরা আহত ও নিহত হচ্ছেন।
তৃণমূলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি দলটির বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল এবং মামলা বাণিজ্যেরও অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানা ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নেন বিএনপির একটি গ্রুপের নেতাকর্মীরা। পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের পর পাথরবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানা ঘেরাও করা হয়। গত ১ জুলাই কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৪৫ জন আহত হন। এরপর আজ একই জেলার বাজিতপুর উপজেলায় পাঁছ বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল দুই গ্রুপের বিরোধের কারণে মারামারির আশঙ্কায় সম্মেলন স্থগিত করা হয়। গত ১১ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এক ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করা নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। চাঁদা না দেওয়ায় গত মার্চ মাসে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে টঙ্গীর তুরাগ থানায়। তেমনি বাসস্ট্যান্ড ও টেম্পুস্ট্যান্ড দখল ও হাটবাজার দখলেরও অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। ঝিনাইদহ সদর এলাকায় স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতার কারণে এবার এক ব্যবসায়ী গরিবদের মাঝে গরুর মাংস বিতরণ করতে পারেননি। তিনি প্রতি বছর কোরবানির ঈদে গরিবদের মাঝে গরুর মাংস বিতরণ করে থাকেন। এলাকার গরিব মানুষের মাঝে তিনি প্রচুর দান করেন। বিএনপির ক্যাডাররা তার গরু রাখার প্যান্ডেল ভেঙে দেয়। ফলে দান করার জন্য কেনা গরুগুলো তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।
বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হুঁশিয়ারি এবং দলীয় অ্যাকশনও কাজে আসছে না। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ‘সুবিধাবাদী’ (নয়া বিএনপি) কিছু নেতাকর্মী এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। দখল, চাঁদাবাজি ও মামলা বাণিজ্যের অসংখ্য অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় দপ্তরে। ফলে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভার পড়ার আশঙ্কা করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
অবশ্য কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে এসব অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও আসছে বিএনপি নেতাদের কাছে। এ কারণে দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় তিন হাজার ২০০ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে দুই হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে। অনেক নেতাকর্মীকে করা হয়েছে সতর্ক।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক-সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি বৈঠকে এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা আমার দেশকে বলেছেন, তারেক রহমান দলীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা যাবে না। তিনি যত বড় ত্যাগী নেতা হোন, যত মামলা থাকুক কিংবা যতই জেল-জুলুমের শিকার হোন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিশৃঙ্খল নেতাদের লাগাম টানতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। কমিটি সারা দেশে যেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সেখানে দ্রুতগতিতে যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ছাড়া শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কোথাও কোথাও তদন্ত ছাড়া দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে দলটি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী বা অপরাধমূলক কাজের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান জিরো টলারেন্স। দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা অসদাচরণ করলেই সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, দলের নামে যে কেউ যে কোনো ধরনের অনৈতিক, অবৈধ, সন্ত্রাসী ও সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড করবে, সে রেহাই পাবে না। আমরা তাৎক্ষণিক তদন্ত করে এবং ভিডিও-অডিওÑসবকিছু পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় সে দায়ী তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করিনি, করছি না… সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, হচ্ছে।
এরই মধ্যে চার-পাঁচ হাজার বিএনপি এবং দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তৃণমূলের বিশৃঙ্খলা নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমার দেশকে গত গত রোববার বলেন, বাংলাদেশে বিএনপি এমন একটি দল, যারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিজ দলের দুই হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে। নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে প্রতিদিন বহিষ্কার হবে, যত ইচ্ছা হবে। প্রয়োজনে আরো বহিষ্কার করা হবে।
তিনি বলেন, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় নিজ দলের ভেতরে কেউ অপকর্ম করলে তার বিরুদ্ধেও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেকে আছে গত ১৭ বছরে জেলে গেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে কিন্তু এখন বিশৃঙ্খলায় জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দল থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। এমন বিশৃঙ্খলা আসছে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি। শীর্ষ এই নেতার মতে, আমরা যেখানে প্রতিনিয়ত প্রতিটি ঘটনার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে বিএনপিতে কেউ অপরাধ করলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্যই আমরা বিশৃঙ্খলা বন্ধ করব। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে।
গত ১০ মাসে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তিন হাজার ২০০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। আরো হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলটির এমন কঠিন অবস্থানে থাকার পরও থেমে নেই নেতাকর্মী ও বিএনপির নাম ভাঙানো লোকদের বিশৃঙ্খলা। যদিও এসব বিষয়ে খুবই কঠোর অবস্থানে থাকতে দেখা যাচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। যখন যে নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দলের নেতাদের অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে বিএনপিতে।
গত বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানা ঘেরাও করে অভিযুক্ত দুই চাঁদাবাজকে ছিনিয়ে নেন বিএনপিকর্মীরা। ওই ঘটনায় পাটগ্রাম থানার আট পুলিশ সদস্য আহত হন বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ দুইজনকে পাটগ্রাম থানায় নিয়ে যাওয়ার খবরে বিএনপিকর্মী ও সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়। গ্রেপ্তারের ঘটনায় অস্থিরতা সৃষ্টি হলে একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় বিএনপি নেতা চপলসহ দলটির ১৪-১৫ জনের মতো আহত হন বলে দাবি করেন তারা।
এ ছাড়া গত মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৪৫ জন আহত হন। এ সময় ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কামাল পাশা ও কিশোরগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ আহমেদের মধ্যে পারিবারিক ও রাজনৈতিক বিরোধ চলছিল। ওই বিরোধের জেরে মঙ্গলবার সকালে কামাল পাশা পক্ষের লোকজন ফরহাদ আহমেদের বাড়ি বাঘাবাড়িতে অতর্কিত হামলা চালান। এতে দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। একপর্যায়ে বাঘাবাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
একই দিন বরগুনার তালতলী উপজেলা বিএনপির দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ১৪ জন আহত হন। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. শহিদুল হকের সমর্থক এবং উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও তালতলী বাজার বহুমুখী সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম মামুন ও উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব মিয়া রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত ১১ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এক ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করাকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে মামুন ভূঁইয়া (৩২) নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বিএনপির এক পক্ষ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনার পক্ষে আর অন্য গ্রুপ বিপক্ষে। বিপক্ষ গ্রুপের দাবি, ছাত্রলীগের নেতার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তারা তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
পরে ১৫ জুন গাজীপুরের কালিয়াকৈরে উপজেলা বিএনপির নবঘোষিত আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। স্থানীয় বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপি ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। নতুন কমিটির নেতাকর্মীরা সকালে আনন্দ মিছিল করেন। বঞ্চিতরাও পালটা মিছিল নিয়ে বের হলে নতুন কমিটির নেতাকর্মীরা ওই মিছিলে বাধা দিলে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এদিকে মাদক কারবারি, চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না তারা। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নিজেদের মধ্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এর মধ্যে গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষে সাইজুদ্দিন দেওয়ান (৪৫) নামে এক প্রবাসী নিহত হন। সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। ওই ঘটনায় ১৬ জনকে বহিষ্কার করেছে জেলা বিএনপি।
এর আগে গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা ও দুই পৌরসভার কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে প্রাণ গেছে মো. জাবেদ নামে এক পথচারীর। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিযোগ বিশ্লেষণ করে নেতারা জানান, সাড়ে ১৫ বছরের সুষ্ঠু ভোটের দাবি ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে না থাকলেও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সুবিধাবাদী বিএনপি নামধারী নেতাদের আনাগোনা বেড়েছে। দলটির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার নেপথ্যেও তারা কাজ করছে। তাদের সুবিধাবাদী আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ একই। তারা বলছেন, যারা বিগত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে দেশে ছিলেন না বা আত্মগোপনে ছিলেন, তারা ৫ আগস্টের পর দেশে এসে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। তাদের এমন অপকর্মের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে দলের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।
এ ছাড়া অনেক নেতা সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চললেও এখন নতুন করে বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে আসীন হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলেও এখন সুসময়ে দলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছে। তাদের আধিপত্য বিস্তারে কোণঠাসা হচ্ছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
সারা দেশের বিশৃঙ্খল নেতারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে কিশোর গ্যাং বা নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বেশিরভাগ জেলায় গত ১৫ বছরে আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্ন অপকর্ম ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীও আত্মগোপনে কিংবা এলাকা থেকে দূরে রয়েছেন।। ফলে সব অপকর্ম ও মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপিতে সুযোগ সন্ধানী দলীয় পরিচয় ব্যবহার করা লোকগুলো।
এদিকে মার্চ মাসে গুলশানে ‘অবৈধ অস্ত্র ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীরা’ লুকিয়ে আছেÑএমন কথা রটিয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে ওই এলাকার একটি বাড়ি লুট করতে যাওয়ার নেতৃত্ব দেওয়া জুয়েল খন্দকার ও তার ছেলে শাকিল খন্দকার ব্যবহার করেন বিএনপির পরিচয়। ওই সময় চক্রটি কথিত ‘জাতীয়তাবাদী চালক দল’-এর সাধারণ সম্পাদক পদ ব্যবহার করেন। পরে বিষয়টি জনসম্মুখে এলে বিএনপির পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার নির্দেশ দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিশৃঙ্খল নেতাদের শৃঙ্খলায় ফেরাতে যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না আমার দেশকে বলেন, দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে যুবদলের কেউ জড়িত থাকার অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হবে। এ ছাড়া কোনো অনুপ্রবেশকারীকে দলে সুযোগ করে দিলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরায় পারিবারিক বিরোধ ও চাঁদা না দেওয়ায় এক ব্যবসায়ীকে জুলাই-আগস্টে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে তুরাগ থানা বিএনপি নেতা মো. মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে। চাঁদা না দিলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। হয়রানি থেকে বাঁচতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মনিরউদ্দিন।
গত মার্চ মাসে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা শাস্তির আওতায় পড়েন। এর মধ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদ তালুকদারের দলীয় প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে গত ৭ মার্চ দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার তিন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অব্যাহতি দেওয়া ওই তিন নেতা গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বিভিন্ন সময় নিজ নিজ এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে দলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হয়। পরে তদন্ত করে তাদের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
তার পরদিন ৮ মার্চ জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়ন বিএনপির দুই নেতাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাঁদাবাজির অভিযোগে যৌথবাহিনীর হাতে আটক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৯ মার্চ ভাঙচুর, লুটপাট ও চাঁদাবাজির দায়ে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নাজিরপুর তাঁতেরকাঠী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে এনায়েত হোসেন খানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তার পরদিন অর্থাৎ ১০ মার্চ বরিশালের বাকেরগঞ্জে ছাত্রদল নেতার হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়ার ঘটনায় বিএনপির স্থানীয় দুই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সাংগঠনিক শাস্তি পাওয়া দুই নেতা হলেন নিয়ামতি ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক সালাম মৃধা এবং যুগ্ম আহ্বায়ক শাহিন ফরাজী।
বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরা ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ন্ত্রণ নিতে বিভিন্ন অপকর্মে নিজেদের যুক্ত করছেন। বিশেষ করে কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। তাদের এমন অপকর্মের জন্য এলাকার মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দলটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা জাকির হোসেন গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী যুবলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্থানীয় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম ও সাবেক উপজেলা চেয়রাম্যান রাজীবের ছত্রছায়ায় এলাকায় চাঁদাবাজি, জমি দখল ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি আবার বিএনপির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। ভাগিয়ে নেন সাভার উপজেলা জিয়া মঞ্চের সাধারণ সম্পাদকের পদ। পদ পেয়ে তিনি স্থানীয় বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। তার নির্যাতনে গুরুতর আহত হন বনগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক জহির উদ্দিন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা মহিলা দলের সভানেত্রী হন আরজিনা পারভীন চাঁদনী, যিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি থেকে সংরক্ষিত আসনের এমপি প্রার্থী হতে মনোনয়নও নিয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমানসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ছবিও আছে তার। এতকিছুর পরও আরজিনাকে সভাপতি হিসেবে বেছে নেন গাইবান্ধা জেলা মহিলা দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সমালোচনার মুখে স্থগিত করা হয় কমিটি। টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক এই নেত্রীকে উপজেলা মহিলা দলের সভানেত্রী পদে বসানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় বিশৃঙ্খলার বিষয়ে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমার দেশকে বলেন, সারা দেশে যেখানে বিশৃঙ্খলার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে এবং অভিযোগ আসছে, সেখানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের হাইকমান্ড কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, যেখানে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে একটি মেসেজ দেওয়া আছে, যেখানে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থ্যা নেওয়া হচ্ছে।
সুবিধাভোগীরা দলের মধ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, দুষ্ট ও সুবিধাভোগীদের দলে কোনো জায়গা নেই। সমাজে দীর্ঘদিনের যে পচন, তা রোধ করতে একটু সময় প্রয়োজন। আশা করি ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খলা কমে আসবে। কারণ আমরা যেমন বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি, তেমনি আইনগত ব্যবস্থাও নিচ্ছি।
দলটির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু আমার দেশকে বলেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরপরও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে না এলে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।