Image description

আব্দুল হান্নান মাসউদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পুরো জুলাই মাস তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন। আর আন্দোলনকে একটি সামগ্রিক রূপ দিতে কখনো ফেসবুক লাইভ, কখনো বা সাংবাদিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন ইস্যুতে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তার কথার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সে সময়ের অনেক অজানা কথা। হান্নান মাসউদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। যার ফলে দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন তাকে হল ছাড়তে বাধ্য করে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তার রাজনীতির শুরুটা হয় ছাত্র অধিকার পরিষদ দিয়ে। ন্যায় ও নীতির ব্যাপারে আপস না করে পরিষদের রাজনীতি থেকেও সরে আসেন তিনি। হান্নান মাসউদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী।

বাসস : আপনার রাজনীতির যাত্রাটা কবে থেকে শুরু হয়েছে, কী চিন্তা থেকে রাজনীতিতে আসেন আপনি? 

হান্নান মাসউদ: আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস কেবল জুন থেকে শুরু হয়নি। আমার রাজনীতির শুরুটা ২০২২ সাল থেকে। তখন হল ছেড়ে দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনীতিতে যোগ দেই। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়ভাবে যে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে অত্যাচার চলছিল সেগুলোর প্রতিবাদ করা। আমার চিন্তা ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ কাউকে না কাউকে করতে হবে। একটি অংশকে অবশ্যই জেগে উঠতে হবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। যারা সত্য তুলে ধরবে তারা সংখ্যায় যত কমই হোক এক সময় মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে। এমন চিন্তা থেকে আমার রাজনীতিতে আসা।   

বাসস : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে আপনি কোন প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছেন?

হান্নান মাসউদ: আমি তখন মোহাম্মদপুরে থাকি। টিউশন থেকে আসার পর আমরা যারা একসাথে রাজনীতি করতাম তাদের মধ্যে অনলাইনে একটি মিটিং হয়। মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ জুন সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করি। আমরা ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীদের ভালো সাড়াও আমরা পাই। সেদিনের প্রোগ্রাম থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, ক্রাউড ফান্ডিং করে আমরা আন্দোলন পরিচালনা করবো। ওইভাবেই আমরা আন্দোলনের সকল খরচ বহন করতাম শুরুর দিকে। জুনের ১২ তারিখ পর্যন্ত আমরা বিক্ষোভ মিছিল চালু রাখি। 

১২ জুন আমাদের একদল প্রতিনিধি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে স্মারকলিপি দিতে হাইকোর্টে যায়। তিনি সেদিন আমাদের সাথে দেখা না করলেও আমরা তার অফিসে তা জমা দিয়ে আসি। সেখানে আমরা এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশের মুখোমুখি হই। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের জেরা করেন।

বাসস : ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটি কীভাবে আসে? 

হান্নান মাসউদ: ১২ জুন অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেওয়ার পর আমরা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেই। ১ জুলাই থেকে আবারও বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করি। ৪ জুলাই কোটা নিয়ে হাইকোর্টের শুনানি ছিল। আমাদের চিন্তা ছিল, সেদিন যদি রায় স্থগিত না করা হয় তবে আমরা এই আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড় করাবো। এরপর আমাদের মধ্যে আলোচনায় আমি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটি প্রস্তাব করি। সেখান থেকে সর্বসম্মতিক্রমে এই নামটি উঠে আসে।  

বাসস : ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ‘রাজাকার’ বলার প্রতিবাদে ‘ তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার ’ স্লোগান দিয়ে হল থেকে বের শিক্ষার্থীরা। ওই দিনের রাতের ঘটনা নিয়ে কিছু বলেন।  

হান্নান মাসউদ: শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলেন। তারা জানায়, মন্ত্রী পর্যায়ের কয়েকজন আমাদের সাথে বসতে চায়। আমি সেখানে খুব জোরালোভাবে বলি যে, দেখেন আমাদের দাবিগুলো খুব পরিষ্কার। আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার নিশ্চয়তা দিলে আমরা তাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বিবেচনা করতে পারি। একই সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এমন নিশ্চয়তা যদি দেয় তবে আমরা বসবো। আমরা সেখানে সিদ্ধান্ত শুনতে যেতে পারি। বড় কোনো আলোচনা করার জন্য আমরা যাব না। এই আলোচনার মধ্যেই আমরা সেখান থেকে চলে আসি। এরপর সেদিন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দেয় যে, আন্দোলনের কারণে জনভোগান্তি হলে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা ভাবছিলাম যে, হয়তো এসব হুমকির কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হবে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল। ১৪ তারিখ বিকেলে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করেন। সেদিন রাতেই শিক্ষার্থীরা সকল হল থেকে একযোগে মিছিল নিয়ে বের হয়ে শেখ হাসিনার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে। এর আগে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় মতিয়া চৌধুরী কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করে। এর প্রতিবাদে তখন মিছিল করা হয়। ২০১৮ সালের ঘটনা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। সকল ভয়, রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নারী শিক্ষার্থীরা সেদিন গভীর রাতে হল থেকে থালা, বাটি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন রাতের ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সারাদেশের সকল ক্যাম্পাস থেকে অস্তিত্ব হারানো শুরু করে। সেদিনের ঘটনায় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। অনেক ছাত্রলীগ নেতা সেদিন পদত্যাগ করে।

বাসস : ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার সূত্রপাত হয় কীভাবে? পরবর্তী অন্যান্য ছাত্রসংগঠন আপনাদের কীভাবে সহযোগিতা করেছিল তখন?  

হান্নান মাসউদ : ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি ছিল। রিফাত, হাসিবসহ কয়েকজন ক্যাম্পাসে মাইকিং করতে হলপাড়ায় যায়। সেখানে একাত্তর হল ছাত্রলীগের কয়েকজন তাদের হামলা করে। এ খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য থেকে হল পাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। তখন মধুর ক্যান্টিনে সাদ্দাম, ইনান, সৈকত ও শয়নের অনুসারীরা লাঠি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল। শিক্ষার্থীদের ওইদিকে গেলেই তারা সেখানে হামলা শুরু করে। এসময় তাদের সাথে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিল। নারী শিক্ষার্থীরাও তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। হামলার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, বিক্ষোভ মিছিল করবো। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, শিবিরের কাছে বিক্ষোভ মিছিল করার ব্যাপারে সহযোগিতা চাই। তাদের তেমন কোন সাড়া না পেয়ে আমরা ১৫-২০ জন মিলে মিছিল করার জন্য হাঁটা দেই। পুলিশ আমাদের দোয়েল চত্বর আটকায়। সেখান থেকে আমাদের আর সামনে যেতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই আমরা পরদিন রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভের ঘোষণা দেই। 

বাসস : ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগকে হলছাড়া করার প্রক্রিয়ায় ছাত্রদল, শিবির ও অন্যান্য সংগঠনের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়েছে আপনাদের? 

হান্নান মাসউদ : ১৫ তারিখ সন্ধ্যার পর আমরা আর সেভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি। পরদিন আমরা ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করি। সেখানেও পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আমার দুই পায়ে রাবার বুলেট লাগে। আমি তখন পায়ে ব্যথা নিয়ে  বসে পড়ি। সূর্যসেন হলের দিকে ছিল পুলিশ আর বঙ্গবন্ধু হলের দিকে ছিল  ছাত্রলীগ। তখন সাংবাদিকরা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেদিন সন্ধ্যার পরে আসিফ ভাই কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা দেন।  

বাসস : আন্দোলনের এই পর্যায়ে সংকটপূর্ণ একটা সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। ১৭ জুলাই সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেন। 

হান্নান মাসউদ : আন্দোলনের এই সময়টাতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিল আমার টিউশনের ফ্যামিলি। স্টুডেন্টের বাবা-মা আমাকে খুব যত্ন করতেন। ওই সময়ে আমাকে তারা নিজেদের বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। পুরো আন্দোলনে আমার জন্য অনেক করেছেন তারা। আন্দোলনের সময় আন্টি নিজের হাতে রান্না করে শিক্ষার্থীদের খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তায় নিয়ে যেতেন । ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস থেকে চলে যাওয়ার পর ওনার বাসায় আমি ১৯ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। ১৮ তারিখ দুপুরের দিকে আংকেল আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, শেখ হাসিনা তো পালাবে মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সবকিছু ঘেরাও করে রেখেছে। টিভি স্ক্রিনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ যখন দেখছিলাম, আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মনে হয় সফল হতে যাচ্ছি।

বাসস : ১৯ তারিখ রাতে ৯ দফা ঘোষণা করা হয়। আর সেদিন রাতেই নাহিদ ইসলামকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতেই তিন সমন্বয়ক মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করেন। সেদিন আপনার সাথে কী হয়েছিল? 

হান্নান মাসউদ: সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে ডিবি থেকে ফোন দেয়। সেখানে থাকা তিন সমন্বয়কের একজন আমাকে খুব জোরাজুরি করেন ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য। আমাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন।  আমাকে ওই সমন্বয়ক বলেছিলেন, নাহিদ ও আসিফ জামাত-শিবিরের টাকা খেয়ে আন্দোলন করছে। নানাভাবে প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন তখন। আমি একবারে স্পষ্ট করে বলেছি আমি যাব না। এক পর্যায়ে আমাকে বলেছিলেন, এই যে এত এত লাশ পড়ছে এটার শেষ কোথায়? আমি বলেছি, হয় শেখ হাসিনার পতন ঘটবে না হয় আমাকে মেরে ফেলবে। তবেই এটার শেষ হবে। সেই একই ফোনে ডিবির সাথেও আমার কথা হয়। তারাও নানাভাবে হুমকি দিয়েছে আমাকে। এই ঘটনার পর আংকেলের বাইকে করে আমি মোহাম্মদপুর গিয়ে আমার আরেক স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকি। পরদিন আমার এক মামার বাসায় চলে যাই।   

বাসস : নাহিদ ইসলাম যেদিন গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যায় সেদিন আপনারা সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেদিন আপনাদের সাথে কী কথা হয়েছিল সেখানে? 

হান্নান মাসউদ: সেদিন মামার বাসা থেকে আমি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে আসি। হাসপাতালে আসার আগে আমাদের দুইজন সমন্বয়কের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, তার কাছে কারফিউ পাস আছে, গাড়ি আছে। সে আমাকে তার সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। আমি সরাসরি না করি। এর আগে কয়েকবার গাড়ি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি সরাসরি না করে দিয়েছি। আমি নিজেই সিএনজি করে গণস্বাস্থ্যে যাই। সেখানে যাওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারো সাথেই আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকে আবার প্রথমদিন যে স্টুডেন্টের বাসায় ছিলাম, তাদের কাছে ফিরে যাই। সে বাসায় যাওয়ার পর জানতে পারি আমার এলাকার এক বড় ভাই আমাকে খুঁজতে এসেছিলেন।  

বাসস : ওই সময়ে আপনারা যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন।

হান্নান মাসউদ: সেদিন গণস্বাস্থ্যের সামনে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করি। সংবাদ সম্মেলন শেষে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমার এলাকার ওই বড় ভাই (গাফফার) সেদিন গণস্বাস্থ্যে ছিলেন। সাংবাদিকদের সহযোগিতায় তিনি সেদিন অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে কলাবাগানের একটা বাসায় নিয়ে রাখেন। সেদিন রাতেই সেখান থেকে বোরকা পরিয়ে তিনি রামপুরায় একটা বাসায় নিয়ে যান আমাকে। সেখান থেকে ২৩ তারিখ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ভাইয়ের চেম্বারে আসি। উনি যাত্রাবাড়ীতে উনার ভাইয়ের কাছে আমাকে রাখেন। সেখান থেকে ২৫ তারিখ বের হয়ে মোহাম্মদপুর আসি। এর মাঝে নাহিদ ভাই ফোন দিয়ে আহতদের খোঁজ খবর নিতে বলেন। পাশাপাশি আইনজীবীদের নিয়ে একটি লিগ্যাল সেল তৈরি করার পরামর্শ দেন। তিনি একটা মেডিকেল টিম তৈরি করার কথাও বলেন। হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ নেয়ার পরামর্শ দেন। আমরা সেদিন আহতদের সাথে দেখা করতে উত্তরায় বাংলাদেশ হাসপাতালে যাই । সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, পুরো হাসপাতালে আহতদের কোন রেকর্ড নেই। তারা আমাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করছিলেন না। তারপরও আমরা একজন আহতের খোঁজ পেয়ে জোর করে তার সাথে দেখা করতে যাই।

বাসস : সেদিন মাঠপর্যায়ে আর কোনো কার্যক্রম ছিল আপনাদের? 

হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা আটকা পড়ি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের হাতে। তখন গাফফার ভাইকে কল করে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করি। মাহিন ভাইকে অসুস্থ বানিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে। বের হওয়ার সাথে সাথে কয়েকটা বাইক, মাইক্রো আমাদের ফলো করতে থাকে। ড্রাইভার একরকম রেইস করে মার্কিন দূতাবাসের সামনে নিয়ে যান। দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও তারা আমাদের সেখানে আশ্রয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তারা অন্য একটা ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সেখানে একরাতের জন্য আমরা ছিলাম। 

বাসস : ওই সময়ে ভিডিও বার্তা ও কর্মসূচি দিতেন কোথা থেকে?

হান্নান মাসউদ: সেখান থেকে বের হয়ে শহীদুল আলম ভাইয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। উনি গুলশানের একটা স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন আমাদের। সেখান থেকে আমরা কর্মসূচিগুলো দিচ্ছিলাম। সেখানে আমরা তিনদিন ছিলাম। গাফফার ভাইও আমাদের সাথে ছিলেন তখন। উনি আমাদের সেখানে রান্না করে খাওয়াতেন। আমাদের দেখাশুনা উনিই করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে আরেকটি মাধ্যমে আমরা বিহারি ক্যাম্পে চলে আসি। সেখানেও খুব একটা সুবিধাজনক মনে হয়নি। সাথে সাথে বের হয়ে এক ব্যবসায়ীর অফিসে গিয়ে উঠি। সেখানে একদিন থাকার পর সদরঘাট এলাকায় চলে যাই। সেখানেও সেইফ ফিল না হওয়ায় সাথে সাথে বের হয়ে যাই। সেদিন জুলকারনাইন সায়ের ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি মিরপুরে ওনার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। উনার অফিসে গিয়ে আমরা উঠি। সেখানে ২ তারিখ পর্যন্ত আমরা ছিলাম। 

বাসস : ২ তারিখ আপনি একটি লাইভ করেছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু বলুন। 

হান্নান মাসউদ: সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমাকে কল করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কল করে স্বপরিবারে সাক্ষাৎ করার জন্য অফার করা হয়। আমাদের ভবিষ্যতে কোন কিছুর অভাব হবে না। দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেয়ার লোভ দেখানো হয়। আমি বলি, আপনার প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমার ভাইদের রক্ত লেগে আছে। উনাকে বলেন, আমার ভাইদের রক্ত পরিষ্কার করতে। ওই দিনই মিডিয়ায় দেখি ৩০-৪০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এটা দেখার পর আমি ফেসবুকে লাইভ করি। সেখানে বলি, প্রধানমন্ত্রী আপনার দরজা খোলা রাখার দরকার নেই। আপনি বের হয়ে আসেন। জনগণের টাকা খরচ করে গণভবনে থাকার অধিকার আপনার নেই। আপনার অবশ্যই গণভবন ছাড়তে হবে। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেই আমি। সেদিন এক মহিলা সাংবাদিক এক দফার ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।  এক পর্যায়ে উনি আমাকে বললেন, এক মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নাও। আর যদি সিদ্ধান্ত না নিতে পারো তবে আমরা তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমি তখন বলি, আপনি যা ইচ্ছে করেন। মেরে ফেললে মেরে ফেলেন। আমরা এটা দিতে পারবো না। কালকে মাঠ থেকে নাহিদ ভাই এক দফার ঘোষণা দিবেন। তখন নাহিদ ভাইয়ের পরামর্শ ছিল, তোমরা সর্বোচ্চটা ধরে রাখ। না পারলে ঘোষণা দিয়ে দিও। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা বনানী চলে যাই। সেখানে একদিন থাকার পর ৩ ও ৪ তারিখ থাকি বারিধারায়।

বাসস : মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন একদিন এগিয়ে ৪ তারিখ করেছিলেন?

হান্নান মাসউদ: সেদিন আসিফ ভাইকে আমি ফোন দিয়ে মার্চ টু ঢাকা একদিন এগিয়ে আনার পরামর্শ দেই। নাহিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে একদিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেই। জুলাইয়ের ৩০ তারিখ থেকে শিবিরের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। ছাত্রদলের রাকিব ভাইয়ের সাথেও আমাদের যোগাযোগ হয়। ভিডিও করার জন্য তিনি আমাদের ফোন কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা নেই নি। এক্ষেত্রে আমরা  ৫০ হাজার টাকার ব্যবস্থা করি এবং শিবিরের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমরা এই টাকা দিয়ে দুইটা ফোন ক্রয় করি। আমরা সংগঠন হিসেবে শিবিরের সাথে যোগাযোগ করি। কোন ব্যক্তির সাথে নয়।

বাসস : ৫ তারিখ হাসিনার পতন হয়। এ সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল? 

হান্নান মাসউদ: সেদিন খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবন, গণভবনে আসি। কিন্তু সংসদ ভবনে ঢুকিনি। আমার চিন্তা ছিল, যদি কখনো ঢুকি সংসদ সদস্য হয়েই এখানে যাবো। তখন চারদিকে এত এত শুভাকাঙ্ক্ষী.. একেকজন একেক দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরকে আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় নাই। চ্যানেল ২৪-এ আমাদের সেদিন যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু নিয়ে যাওয়া হইছে। তখন আমাদের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে এই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ অন্যরকম হত।