Image description

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচনি রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম দক্ষিণের পাঁচটি আসনে প্রার্থীরা নেমে পড়েছেন মাঠে। সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা গণসংযোগ শুরু না হলেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোই নির্বাচনি রাজনীতিতে পরিণত হতে শুরু করেছে।

গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে যাওয়ায় আপাতত দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে ১৫ বছর ‘জোর করে ক্ষমতা দখলে রাখা’ দলটি। তাদের সহযোগী জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোরও কোনো অস্তিত্ব নেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই আসনগুলোতে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের তরুণ দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতারা একাধিকবার গণসংযোগ করে গেলেও নির্বাচনি মাঠে প্রার্থী ঘোষণা করে এখনো মাঠে নামেনি। তাই ভোটের মাঠে আপাতত রাজত্ব করছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তবে একটি আসনে এলডিপির শক্ত অবস্থান আছে।

ইতোমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করে ভোটের মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির প্রার্থীরা আরো অন্তত দুই মাস আগে থেকেই পুরোদমে নির্বাচনি মাঠে নেমেছেন। সরাসরি ভোট না চাইলেও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় উপস্থিতি ও শোডাউনে জানান দিচ্ছেন নির্বাচনি তৎপরতা। আবার দলীয় কর্মকাণ্ডগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থীদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে কর্মীদের। এলডিপির প্রার্থীও মোটামুটি চূড়ান্ত। স্বৈরাচার পলায়নের পর থেকে তারাও সক্রিয় রাজনীতিতে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত বিএনপির নির্বাচনি মাঠ এখনো অগোছালো। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগা দলটি মাঠে এসেছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের লন্ডনে বৈঠকের পর থেকে। কিন্তু মাঠ গোছাতে পারেনি এখনো। দলটির মনোনয়ন পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন একাধিক নেতা। ভোটারদের কাছে আলোচনায় থাকার পাশাপাশি হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় মরিয়া তারা।

এদিকে একাধিক নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার কারণে একাধিক স্থানে দুই নেতার সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিব্রত দলের হাইকমান্ড। নেতারা বলছেন, বড় দলে ছোটখাটো বিরোধ ও প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর জয় ছিনিয়ে আনতে মাঠে নামবে।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া)

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১২ আসনে জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী গাজী শাহজাহান জুয়েল। পরে আসনটি চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে। তবে এবার সেই আসন পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও ভোটে ছাড় দিতে নারাজ। তাই আগামী নির্বাচনে কে হবেন পটিয়াবাসীর কাণ্ডারিÑতা নির্ধারিত হবে ভোটের মাঠে।

আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন সাবেক এমপি শাহজাহান জুয়েল, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম, বর্তমান আহ্বায়ক এম ইদ্রিস মিয়া, নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য সৈয়দ সাদাত আহমেদ, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুদ্দীন সালাম মিঠুও নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। এদের মধ্যে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব এনাম ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ভোটারদের মধ্যে তার পরিচিতিও শাহজাহান জুয়েলের চেয়ে কম নয়।

বিএনপির ৫ জনের টানাটানিতে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা ডা. ফরিদুল আলম। দলটির নির্বাচনি বোর্ড ইতোমধ্যে তাকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। গত দুই মাস ধরে তিনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ইসলামি দলের সক্রিয় অবস্থান রয়েছে পটিয়ায়। তবে দলগুলো এখনো নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নামেনি।

চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী)

এ আসনে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সরওয়ার জামাল নিজাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের পাতানো নির্বাচনে এখান থেকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও ‘শেখ হাসিনার ক্যাডার’ খ্যাত আখতারুজ্জমান চৌধুরী বাবুকে। তার মৃত্যুর পর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় বাবুর ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদকে।

আসছে নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে সরওয়ার জামাল নিজাম, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন, কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম মামুন মিয়া এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন।

এর বিপরীতে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন অধ্যাপক মাওলানা মাহমুদুল হাসান। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচনি প্রচার শুরু করেছেন তিনি। বিশেষ করে দলীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

এ আসনের ভোটাররা বলছেন, জনবান্ধব একজন প্রতিনিধি দেখতে চান তারা। আসছে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলে দল কিংবা মার্কা দেখে নয়, প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই করেই ভোট দিতে চান তারা।

চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক)

এ আসনটি এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রমের আসন হিসেবে পরিচিত। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য থাকতে একাধিকবার এ আসন থেকে জয়লাভ করেন তিনি। তবে এবারের নির্বাচনে আসনটি থেকে তিনি নির্বাচন করবেন না। তার ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে প্রচার চালাচ্ছেন এলডিপির নেতাকর্মীরা।

ইতোমধ্যেই কর্নেল অলি তার ছেলে ওমর ফারুককে নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নেওয়া শুরু করেছেন। ২০০১ সালে গঠিত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে অলি আহমদ বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে মিজানুর রহমান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অলির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু অলির কাছে ধরাশায়ী হন মিজানুর।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ডা. মহসিন জিল্লুর করিম এবং ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মিজানুল হক চৌধুরী মনোনয়ন চাইতে পারেন।

এদিকে এলাকায় ‘মানবিক চিকিৎসক’ হিসেবে পরিচিত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাদাত হোসেনকে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। দল-মত নির্বিশেষে ডাক্তার শাহাদাতের পরিচিতি রয়েছে। সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা মাঠে থাকায় প্রচারও জমে উঠেছে।

ভোটাররা জানান, সবকিছু ঠিক থাকলে আসনটিতে লড়াই হবে ত্রিমুখী। কারণ বিএনপি, এলডিপির মতো জামায়াতে ইসলামীরও শক্ত অবস্থান রয়েছে এলাকাটিতে। নেতারা পালিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররাও জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। তাই নির্বাচনি প্রচারে তিন পক্ষই শুরু থেকেই বেশ কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া)

এ আসনটি ১৯৯১ সাল থেকে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০০১ সালে সারা দেশে চারদলীয় জোটের ভিত্তিতে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন করলেও এই আসনে ছিল ভিন্ন চিত্র। আসনটিতে বিএনপির পক্ষ থেকে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রম ও জামায়াতের পক্ষ থেকে শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচন করেন। নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক ভোট বেশি পেয়ে শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচিত হন।

পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন জামায়াতের সামসুল ইসলাম। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদও। সে নির্বাচনেও হেরে যান অলি আহমদ।

এদিকে আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষ থেকে এ অঞ্চলের ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সদ্যবিদায়ী আমির শাহজাহান চৌধুরীকে দলটির একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বিপরীতে বিএনপির পক্ষ থেকে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন সাতকানিয়া বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শেখ মো. মহিউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, বর্তমান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরী, বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক জামাল হোসেন, লোহাগাড়া বিএনপির সাবেক সভাপতি আছহাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাবেক আহ্বায়ক নাজমুল মোস্তফা আমীন। এ ছাড়া সাতকানিয়ার বাসিন্দা শিল্পপতি আবুল বাশার আবু বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)

এ আসনে সাবেক মন্ত্রী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বারবার নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। তার মৃত্যুর পর থেকে প্রভাবশালী কোনো নেতা উঠে আসেননি বললেই চলে। আসন্ন নির্বাচনে জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী মহসীন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইউপি চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও বাঁশখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল ইসলাম হোসাইনী বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করে এলাকায় জনমত গঠনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

অপরদিকে জামায়াতের পক্ষে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা জহিরুল ইসলামকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। শুধু বাঁশখালী উপজেলা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৬ আসনটি। ২০১৩ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাওলানা জহিরুল ইসলাম। তাই তাকে নিয়ে এ আসনটি জয় করার স্বপ্নে বিভোর জামায়াতে ইসলামী।

এ ছাড়া ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হকও এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন বলে জানা গেছে।

নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় মহাসচিব আল্লামা মুছা-বিন ইজহারও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বাঁশখালী বড় মাদরাসায় অনুষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির এক সভায় মুছা-বিন ইজহারকে তাদের দলীয় মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেই।