Image description

চাঁদাবাজি ছিল মূল কাজ। এদিক-সেদিক হলে লোকজনকে ধরে এনে মারধর করত। এ জন্য দুটি স্থান ব্যবহার করত। একটি পরিত্যক্ত ঘর এবং অন্যটি খোলা স্থান। আশপাশের লোকজন নির্যাতিতদের চিৎকার ও কান্না শুনলেও এতদিন ভয়ে কিছু বলেননি। বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের (সদ্য বহিষ্কৃত) সহসাধারণ সম্পাদকের জিতু ইসলামের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয়রা জানান, জিতু নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করত সদরের ফুলবাড়ি উত্তরপাড়া সেতুর পাশের ঘর। এটি ফুলবাড়ির ডিউজ নামে এক ব্যক্তির। তিনি ঢাকায় থাকায় পড়ে থাকে। এর প্রায় ৩০০ গজ দূরে জোড়াঘাটে (নয়ানদী) আছে আরেকটি নির্যাতনের স্থান। সেটি ফাঁকা জায়গা। তবে চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা। এখানে রিকশাচালক শাকিলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাস তিনেক আগে সন্ধ্যায় জোড়াঘাটে হঠাৎ ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে এক ব্যক্তির চিৎকার শোনা যায়। তখন কয়েকজন প্রতিবেশী এগিয়ে গিয়ে দেখেন, এক ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে। পাশে আরেক ব্যক্তিকে পিছমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। তিনিও ‘পানি, পানি’ বলে কাতরাচ্ছেন। স্থানীয়দের দেখে জিতু বলেন, ‘সোজা বাড়ি যান। মুখ বন্ধ রাখবেন। না হলে আপনাদেরও এ হাল হবে।’ ভয়ে তারা সেখান থেকে চলে আসেন।

একাধিক ব্যক্তি জানান, চাঁদাবাজি ছিল জিতুর প্রতিদিনের কাজ। ফুলবাড়ি, শিববাটিসহ কয়েকটি এলাকার কে কত টাকার মালিক, সে অনুযায়ী তাদের নিশানা করত। এর পর চাঁদার জন্য লোক পাঠাত। তাকে চাঁদা না দিয়ে নিস্তার পেতেন না কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিববাটির এক ব্যক্তি বলেন, ‘নতুন বাড়ির কাজে হাত দিলে জিতু বাহিনী ৫ লাখ টাকা চাঁদা চায়। টাকা না দেওয়ায় রড, বালু ও ইট জোর করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। ভয়ে তাদের নামে থানায় অভিযোগ করিনি।’

মহাস্থান এলাকায় জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই বছর আগে আব্দুল হাকিমকে তুলে এনে শিববাটি উত্তরপাড়া সেতুর পাশে ঘরে আটকে রাখে জিতু। তাকে মারধর করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী আব্দুল হাকিম সমকালকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে এলাকার এক ব্যক্তির জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ওই ব্যক্তির হয়ে জিতু আমাকে মহাস্থান বন্দর থেকে মাইক্রোবাসে তুলে ফুলবাড়ি উত্তরপাড়া সেতুর পাশে ঘরে আটকে রাখে। এরপর আমাকে মারধর করে। আমি যেন ওই জমির দাবি না করি এ জন্য হুমকি-ধমকি দেয়। এক পর্যায়ে তাকে এক লাখ টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দেয়। পরে বিষয়টি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুকে জানাই। তিনি বলেন, মামলা করো না। আমি বিষয়টি দেখছি। একাধিকবার ধরনা দিয়েও রিপুর কাছে আর কোনো প্রতিকার পাইনি।’

ফুলবাড়ির বাপ্পী হাসান বলেন, ‘আমি প্রায় দেড় বছর আগে পুরোনো মোটরসাইকেল বেচে নতুন একটি কিনতে চেয়েছিলাম। জিতু জানতে পেরে আমার কাছ থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে যায় ৯০ হাজার টাকা দাম ধরে। কিন্তু ৩ মাসেও টাকা না দেওয়ায় আমি জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশিষ পোদ্দার লিটনকে জানাই। এর পর জিতু আমাকে রাস্তা থেকে ধরে যেখানে শাকিলকে খুন করেছে, সেখানে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। মার খেয়ে এবং মোটরসাইকেল হারিয়েও জিতুর বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পাইনি।’

আগস্টের আগেও ছিল বেপরোয়া
জিতু জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশিষ পোদ্দার লিটনের অনুসারী হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) ২টি বাস ইজারা নেয়। পরে চালক নিয়োগ দিয়ে বাসগুলো রাস্তায় ভাড়ায় চালাত। এ থেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় হতো। এই টাকা জিতু নিত। বিআরটিসির বাসের সঙ্গে এক সময়ে জড়িত থাকা সুলতান আহম্মেদ নামে এক ব্যক্তি এ তথ্য জানিয়ে বলেন, জিতুর প্রভাব আগস্টের আগে ছিল যুবলীগ নেতার ছত্রছায়ায়। বিআরটিসির পরিচালক ছিলেন শুভাশিষ। মূলত তার মাধমে বাসগুলো জিতু নেয়।

পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তৌহিদ আলম বিটু বলেন, ‘জিতু পেশাদার সন্ত্রাসী। দলকে সে ব্যবহার করে অপরাধ কর্মকাণ্ড করেছে। চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাই তার পেশা। আওয়ামী লীগের নুরু বাহিনীর ক্যাডাররা এখন জিতুর দলে। জিতু ও নুরু ভিন্ন দল করলেও আগে একসঙ্গে অনেক অপকর্ম করেছে। আসলে সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। এরা দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়।’

লিটনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে জিতুর অংশ নেওয়ার একাধিক ছবি আছে। তার পরও তাকে স্বেচ্ছাসেবক দলে পদ দেওয়া হয়।

পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আমিনুল ফরিদ বলেন, ‘জিতুর কোনো জাতপাত নেই। যে পাতে খায়, সে পাত ফুটো করে। ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী, সুযোগসন্ধানী।’

জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মাশরাফি হিরোর সঙ্গে জিতুর সখ্য ছিল। তার পরও ৫ আগস্টের পরদিন ফুলবাড়িতে মাশরাফি হিরোর ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস দখল করে জিতু।

ঘোষণা দিয়ে খুন
শিববাটির শাহি মসজিদের এক মুসল্লি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় আগে মাদক ব্যবসা ছিল না। এখন এলাকার তরুণ-যুবকসহ গরিব মানুষকে দিয়ে মাদক ব্যবসা করায় জিতু। তার ছোট ভাই নিতুও মাদকসহ দুটি মামলার আসামি। সে দিনে রংমিস্ত্রির কাজ করে। রাতে ছিনতাই ও ডাকাতি করে। জিতু আগে থেকে এতটা ভয়ংকর যে ২২ বছর বয়সে ঘোষণা দিয়ে রবিউলকে খুন করেছিল। বালুর ব্যবসা নিয়ে রবিউলের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে জিতু প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়, সাত দিনের মধ্যে খুন করবে। তার এ ঘোষণার ছয় দিনের মাথায় তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।’

জিতুর বাহিনীতে যারা
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জিতুর যে ২২ জন ক্যাডার রয়েছে, এর প্রায় অর্ধেক ছিল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম নুরুর। ৫ আগস্টের পর নুরু আত্মগোপনে যান। তাঁর বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ১৩ জন যোগ দেয় জিতুর দলে। তার হাতে চলে যায় এলাকার একক আধিপত্য। সেই সঙ্গে দলের পদ বাগিয়ে নেওয়ায় তার অনুসারী ক্যাডারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। 

জিতু বাহিনীর সদস্য হলো শিববাটি ঘোড়াপাড়ার রাজু, শাহি মসজিদ লেনের মতিউর রহমান মতি, মমিতুন, আজিম উদ্দিন, ফুলবাড়ি কারিগরপাড়ার শফিকুল হাসান বিপ্লব, মিঠু, ভাটাপাড়ার রিয়াজ উদ্দিন, পাইকপাড়ার ফরহাদ হোসেন, মধ্যপাড়ার মইনুল, দক্ষিণপাড়ার আশিক, মৃধাপাড়ার মিরু হোসেন, সুমন, আবু সাঈদ, বৃন্দাবনপাড়ার মিলন হোসেন, মানিক, রাব্বি, জিতুর ভাই নিতু, শিববাটির তুষার, সাজু, আনোয়ার হোসেন, ফুলবাড়ির রিপন ও মামুন। তাদের মধ্যে জিতুসহ ১৭ জনের নামে মামলা হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে মামলায় দেখানো হয়েছে।

সাতজনের নামে ছিল মামলা
জিতুর ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে সাতজনের নামে আগের মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জিতুর ভাই নিতুর বিরুদ্ধে আছে ২ মামলা। এর একটি মাদকের ও অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। এই দুই মামলায় সে জামিনে আছে।

রবিউল ইসলাম হত্যায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে জিতুর সঙ্গে শরিফুল হাসান বিপ্লবকে আসামি করা হয়েছিল। তাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করার পর কয়েক বছর জেল খাটে।

মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে ২টি মাদক মামলা রয়েছে। তাকে পুলিশ ২ বার গ্রেপ্তার করে। এখন সে জামিনে আছে।

মানিক আগের একটি হত্যা মামলার আসামি। রাব্বী একটি মাদক মামলার আসামি। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। বর্তমানে সে জামিনে।

মমিতুন ও মঈনুলের নামে একটি করে মাদকের মামলা আছে। তারাও বর্তমানে জামিনে আছে। আর রিকশাচালক শাকিল হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া ১২ জনের মধ্যে এরাও ছিল।

পা ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন শাকিল
মামলার ১ নম্বর সাক্ষী সিফাত হোসেন বলেন, জিতু তার ক্যাডারদের নিয়ে এসে শাকিলের বাড়ি ঘিরে ফেলে। শাকিলকে তুলে করতোয়া নদীর জোড়াঘাটে বাগানের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে পিটিয়ে খুন করে। পেটানোর সময় শাকিল পা ধরে ‘বাপ’ বলে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। পানি খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিতুর মন গলেনি। সে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

রিমান্ডে মিলছে তথ্য
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) জোবায়ের খান বলেন, জিতুসহ গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এ ছাড়া হত্যায় ব্যবহৃত লাঠিসোটা উদ্ধার করা হয়েছে। শাকিলকে পেটানোর ভিডিও ফুটেজ আছে। তাই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির প্রয়োজন নেই। এখন অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

প্রসঙ্গত, শহরের শিববাটির শাকিল হোসেনের ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে উত্ত্যক্ত ও বিয়ের প্রস্তাব দেয় জিতু। এতে রাজি না হওয়ায় গত ১৪ জুন শাকিলকে পিটিয়ে হত্যা করে জিতুসহ তার বাহিনী। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী মালেকা খাতুন বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ জিতু, তার সহযোগী মতি ও বিপ্লবকে গ্রেপ্তার করে। এরপর স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে জিতুকে বহিষ্কার করা হয়।