Image description

দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ধারণা করা হয়েছিল, দ্রুতই দেশে ফিরবেন তিনি। কিন্তু অভ্যুত্থানের দশ মাস পেরিয়ে গেলেও তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিনক্ষণ জানা যায়নি। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। 

গত সপ্তাহে (১৩ জুন) লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন তারেক রহমান। সেখানে বিচার ও সংস্কারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে পারে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। এরপরই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়। 

বিএনপির দলীয় এবং তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমান দেশে ফিরেই আগামী নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। সে হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের ফিরবেন, এমন ধারণাই দেওয়া হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দ্রুততার সঙ্গে তারেক রহমান প্রায় সকল মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এ ছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ আরো যেসব মামলায় সাজা হয়েছিল আদালতের রায়ে তার সবগুলো থেকেই তিনি খালাস পেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে এই মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো ধরনের বাধা নেই। আইনি এবং রাজনৈতিক সব বাধা দূর হলেও তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, এ বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি। 

এ বিষয়ে তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলন, কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি, তবে নির্বাচনের আগে তিনি দেশে আসবেন। এ ব্যাপারে তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা বিশ্বাস করি খুব দ্রুতই নির্বাচন হবে আগামী বছর রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং অবশ্যই তার আগে তিনি ফেরত আসবেন। যথোপযুক্ত আইনি এবং রাজনৈতিক পরিবেশ যখন সৃষ্টি হবে, যেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, সবার জন্য ভালো উনি অবশ্যই নির্বাচনের আগে সেই সময়টাতে আমাদের মাঝে উপস্থিত হবেন। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপিসহ দেশের সব মানুষ তারেক রহমানের জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। উনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যে কোনো সময় একটি দিনক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে চলে আসবেন।

হঠাৎ সচল ২১ আগস্টের মামলা

গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কোনো মামলা খারিজ অথবা কোনো মামলায় খালাস পেয়ে যান তারেক রহমান। সর্বশেষ গত মার্চে হত্যামামলা থেকে দায়মুক্তির উদ্দেশ্যে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে করা মামলা থেকে তার ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আটজনকে খালাস দিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সামনে থেকে কার্যত সব ‘মামলার বাধা’ সরে যায়। কিন্তু গত ১ জুন একটি মামলা আবার ‘সচল’ হয় আদালতের রায়ে। ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক লন্ডন সফরের কয়েকদিন আগে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ‘লিভ টু আপিল’ করলে ১ জুন তা মঞ্জুর করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ‘লিভ টু আপিল’ মঞ্জুর হওয়ার অর্থ মামলাটি সচল থাকা। আপিল বিভাগে এটা নিয়ে শুনানি হবে। শুনানি শেষে বিচারপতিরা যদি মনে করেন, হাইকোর্ট ডিভিশনের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি তাহলে রায় পরিবর্তনও হতে পারে।

তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রথমে নির্বাচনের তারিখটা ঘোষণা হোক। তারপরে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশে ফিরবেন।’ দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা এবং সাজা নিয়ে আইনগত যে সমস্যা ছিল, সেটি দূর হয়েছে। পাঁচ আগস্টের পর থেকেই রাজনৈতিকভাবেও সমগ্র বাংলাদেশে বিএনপির আধিপত্য দৃশ্যমান। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আসছেন না কেন, এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তার ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ। আইনি প্রক্রিয়া আর নিরাপত্তা দুটো আলাদা বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘ওনার মতো লিডারের সিকিউরিটি কনসার্ন (নিরাপত্তার উদ্বেগ) স্বাভাবিকভাবে আছেই। এটা এশিয়া মহাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। তার মতো সিনিয়র পলিটিক্যাল লিডারের নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় তো আছেই। উনি আসবেন, অবশ্যই আসবেন। আসার আগে তো একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে। সরকারেরও একটা নিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, একটা স্পেস ক্রিয়েট করতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।’

তারেক রহমানের এই উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি গত ১৫ বছরে পুলিশকে কতটা দলীয়করণ করা হয়েছে। আপনার মিলিটারির একটা এলিমেন্টও পলিটিসাইজ করা হইছে। তো এইগুলাকে একটু ক্লিয়ারআপ করতে তো স্বাভাবিকভাবে একটা স্পেস সরকারেরও দরকার আছে। তারা সেটা করছে। আশা করছি, শিগগির সেই জায়গাটা তৈরি হবে।’ 

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তারেক রহমান তখনই আসবেন যখন ওনার দলের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হবেন এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। 

গুলশানের বাড়িতেই উঠবেন

দেশে ফিরে তারেক রহমান কোন বাড়িতে উঠবেন? সেটা নিয়েই জল্পনা চলছে এখন। খালেদা জিয়ার বর্তমান বাড়ি ‘ফিরোজা’র পাশের দোতলা বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার এবং সজ্জিত করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে ৩২ কাঠা জমির ওপর নির্মিত এই বাড়িটি দেওয়া হয়েছিল। গুলশান-২ নম্বরের এভিনিউ রোডের ১৯৬ নম্বর বাড়িটি মোটামুটি প্রস্তুত। অনেকেরই ধারণা, তারেক রহমান এখানেই উঠবেন। বাড়িটিতে বর্তমানে পুলিশের পাহাড়া বসানো হয়েছে। অনুমতি ছাড়া কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি দেশে ফিরে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান বাড়িটি পরিদর্শন করেন।

গুলশান এভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাড়িটি বর্তমানে সংস্কারের কাজের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। একটি বিদেশি কোম্পানিকে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। ৬ মাস আগে বাড়িটি খালি করা হয়। ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে নতুন করে সাদা রং করা হয়েছে। বাইরের অংশটি সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। ভিতরের অংশটিও সাজানো হয়েছে এবং অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য সীমানা দেয়ালে লোহার গ্রিল স্থাপন করা হয়েছে। আধুনিক বাসভবনটিতে তিনটি শোবার ঘর, একটি প্রশস্ত ড্রয়িং এবং লিভিং রুম, একটি সুইমিং পুল এবং দুটি পৃথক প্রবেশদ্বার রয়েছে।

যে প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরতে পারেন 

তারেক রহমান কিভাবে দেশে ফিরতে পারেন? এই মুহূর্তে তো তার কাছে কোনো পাসপোর্ট নেই। নতুন করে পাসপোর্ট নিয়ে, নাকি ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে তিনি দেশে আসবেন? এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলোতে দেশে ফেরার দুই প্রক্রিয়া আছে। ওনার কাছে তো পাসপোর্ট নেই। ফলে উনি চাইলে আমাদের লন্ডনের দূতাবাস তার নামে ট্রাভেল পাস ইস্যু করবে। সেই পাস নিয়েই তিনি দেশে ফিরতে পারেন। আবার তিনি চাইলে পাসপোর্টও দিতে পারে। আমার মতে, তারেক রহমান ট্র্যাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরে এরপর এখান থেকে পাসপোর্ট করলেই ভালো হবে।’