
প্রকাশ্য দিবালোকে চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় ৬ মাস পলাতক থেকে ‘জিয়া মঞ্চে’র সভাপতি হয়ে প্রকাশ্যে এলেন ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার সন্ত্রাসী খাঁজা বাহিনীর প্রধান খায়রুজ্জামান ওরফে খাঁজা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর শহরের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত এক সভায় সংগঠনটির সদর উপজেলার আংশিক কমিটির সভাপতি হিসেবে খায়রুজ্জামান খাঁজার নাম ঘোষণা করা হয়। এছাড়া সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. ইয়াসিন আলী, সাধারণ সম্পাদক মো. শাওন আহমেদ (বাবু), সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মো. চুন্নু বেপারী ও সদস্য মো. মনিরুজ্জামান মিন্টুর নাম ঘোষণা করা হয়।
সভায় জিয়া মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম. টি আখতার টুটুল, ফরিদপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস সাজ্জাদ আহমেদ শাওন, জেলা জিয়া মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবি.এম মোর্শেদ পলাশ ও সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম আলী উপস্থিত ছিলেন।
নবগঠিত কমিটিকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে জিয়া মঞ্চ ফরিদপুর জেলা শাখায় কমিটির কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ফরিদপুরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কানাইপুর ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিল্লাল খানের ছোট ছেলে ওবায়দুর রহমান খান। ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। খাঁজার বিচারের দাবিতে ওই সময় রাজপথে নেমে আসে সাধারণ জনতা। তারপর থেকে দীর্ঘ ৬ মাস পলাতক ছিলেন খাঁজা।
ওই ঘটনায় ওবায়দুরকে তুলে নিয়ে দুই চোখে লোহার পেরেক দিয়ে খোঁচানো হয়, হাত পায়ের রগ কেটে ফেলাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে ওবায়দুর মারা যান। এ ঘটনার পরে ১১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে খাঁজাকে প্রধান আসামি করে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের মা রেখা বেগম। এরপর থেকে পলাতক ছিলেন খাঁজা। এই মামলায় বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও খাজাকে ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শুধু ওবায়দুর হত্যা নয়, কোতোয়ালি থানায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে খাঁজা বাহিনীর প্রধান খাঁজার নামে।
জানা যায়, ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের ভাটী লক্ষ্মীপুর গ্রামের হানিফ মাতবরের ছেলে খাঁজা। তার বড় ভাই বর্তমান কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন।
পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দাদের হাতে একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবা, দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হলেও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামিনে বের হয়ে আসেন খাঁজা। এরপর পুনরায় শুরু করেন ত্রাসের রাজত্ব। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের হস্তক্ষেপে একটি সাজাপ্রাপ্ত মামলায় খালাস পেয়ে বের হয়ে আসেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভোলপাল্টে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন খাঁজা।
বিভিন্ন সময় খাঁজার গ্রেপ্তারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন খায়রুজ্জামান খাঁজা। সড়কে বাসে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় তাকে আটক করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়।
২০২১ সালের ১৫ মে দুইজন সহযোগীসহ কোতোয়ালি থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে খাঁজাকে। তৎকালীন সময়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা জানান, তার বিরুদ্ধে কানাইপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দস্যুতা, ভূমি দখলসহ নানা বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
এরপর ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরে তৎকালীন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান অন্যত্র বদলির পরদিন এলাকায় ছাত্রলীগের বিভক্তিকরণে সহযোগীদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেন খাঁজা। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই ২৮ আগস্ট দেশীয় অস্ত্রসহ খাঁজা ও তার ৪ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতা আব্দুর রহমানের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রকাশ্যে আসেন খাঁজা। তার ছত্রছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কানাইপুরে যুবলীগ নেতা পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নিজেকে জানান দিতো খাঁজা।
তবে জেলা জিয়া মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম আলী জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের আমলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। এছাড়া খায়রুজ্জামান খাঁজাকে বিএনপির ত্যাগী নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। ইব্রাহিম আলী বলেন, ‘খাঁজা কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ রোষানলে তাকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এছাড়া ওবায়দুর হত্যা মামলায় আদালতে এখনো দোষী সব্যস্ত করেনি এবং ঘটনাস্থলেও ছিল না। ত্যাগী নেতা হিসেবে দলে নেওয়া হয়েছে।
ফরিদপুর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান বলেন, ওবায়দুর হত্যার মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তদন্তাধীন রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি সে উচ্চ আদালত থেকে কয়েক সপ্তাহের জামিনে রয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।