
আওয়ামী লীগের শাসনকালে অনলাইনে কোনো মতামত প্রকাশ, বিশেষ করে শেখ হাসিনা, দলীয় ঊর্ধ্বতন নেতা ও রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা কিংবা কোনো আন্দোলন সমর্থনকে জাতীয় ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে এসব ভিন্নমত প্রকাশকারীদের দমন করা হতো। এ কারণে শেখ হাসিনার সময়ে রাজনৈতিক বক্তব্যকে নাগরিক অধিকারের পরিবর্তে অস্থিতিশীলতার কারণ বলে ধরা হতো।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব প্রতিবেদনের কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য দেন।
প্রতিবেদনে বিচারব্যবস্থার নানা বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, ভিন্নমত দমনে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেশের বিভিন্ন থানায় করা মামলার অভিযোগের বক্তব্যে অনেক মিল ছিল। কোটা আন্দোলন, সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন, এমনকি আওয়ামী নেতাদের কটাক্ষ করে ছবি পোস্ট করাকে ধরা হতো বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবে।
মামলার এজাহার ও চার্জশিটের ভাষাও ছিল একই। আইন ও বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পূর্বনির্ধারিত ফরমায়েশি কাঠামো ব্যবহার করা হতো। যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মামলার এজাহার ও চার্জশিটের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে ‘একই বক্তব্য’ ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে কমিশন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাউকে আটকের পর যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ‘গোয়েন্দা তথ্যে’র ভিত্তিতে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ধরা হয়েছে এমন কথা বলতেন আইন সংশ্লিষ্টরা। সব ঘটনায় একই ধরণের বেনামি সূত্র ব্যবহার করা হতো। আইনের এমন ব্যবহারে দেশে জবাবদিহিতাহীন পুলিশিং স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
ওসব অভিযোগের বক্তব্য এমন ছিল, সন্দেহভাজনরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই ‘পালানোর চেষ্টা’ ধরণের বক্তব্য বহু মামলায় দেখা যায়। এর মাধ্যমে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতারকে বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই যে কারও বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপ যথাযথ পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাউকে আটকের পর সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাৎক্ষণিক স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো। বেশিরভাগ ঘটনায় পুলিশের লিখিত অভিযোগ এমন ছিল যে, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজনরা নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। মূলত এ ধরণের তাৎক্ষণিক স্বীকারোক্তি আইনসিদ্ধ নয়।
এতে আরও বলা হয়, ভিন্নমত দমনকারীদের আটকের পর জব্দ তালিকায় ও চার্জশিটে ধর্মীয় বিভিন্ন পুস্তক ও নথিপত্রকে ‘জঙ্গিবাদী’ সাহিত্য কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে দেখানো হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সব সময় দাবি করা হতো, গ্রেফতারের সময় ডজন ডজন ‘জিহাদি’ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে। একটি ব্যাগ বা ড্রয়ারে সেগুলোকে রেখে ‘জিহাদি পুস্তক ও নথিপত্র’-এমন টেমপ্লেট ব্যবহার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হতো।
জব্দ পুস্তকের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মূলত ধর্মীয় সাহিত্যকে জঙ্গিবাদ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে কমিশন উল্লেখ করে, দেশের কোথাও নতুন মামলা হলেও একই ধরণের স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করা হতো। যাচাইবিহীন গোয়েন্দা তথ্য, কপি-পেস্ট স্বীকারোক্তি এবং ধারণাপ্রসূত অপরাধের বিবরণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারসংশ্লিষ্টদের সত্যতা যাচাই থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এ ধরনের কার্যক্রম মামলার বৈধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিন্নমত দমনে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা দ্বারা আদালতের ওপরও প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলায় বিচারিক নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি। ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ভুক্তভোগীদের চাপে রাখতে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মামলাগুলো স্থগিত রাখা হয়। এ ধরণের দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার বোঝা টানতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা অর্থ, সুনাম এবং মানসিক ক্ষতির শিকার হন। আওয়ামী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে শুধু জাতীয় নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসাবে নয়, বরং রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র অনুমোদিত হয়রানির অস্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
কোনো মামলা পরিচালনায় ভুক্তভোগীর ৭ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে, যা ওই পরিবারের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণ। অর্থাৎ, বেশির ভাগ পরিবার আইনি খরচ চালাতে গিয়ে দুই বছরের বেশি সময়ের আয় ব্যয় করেছেন। অনেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আরও বেশি খরচ করেছেন, যা প্রায় পাঁচ বা ছয় বছরের আয়ের সমান। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেছে। আবার অনেকে দীর্ঘস্থায়ী ঋণচক্রের মধ্যে আটকা পড়েছে।
গুমের কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ১৫-১৬ বছর বয়সি এক কিশোরের বড় ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরির বিষয়টি দেখেছেন কমিশন। ওই তরুণকে নির্যাতনের পর তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হতো।
কমিশন সুপারিশে বিচারকদের জন্য বিচারকার্য পরিচালনায় আপিল বিভাগের স্বতসিদ্ধ নিয়ম আমলে নেওয়ার কথা বলেছেন। এর ফলে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে। তখন বিচারকরা কোনো ধরণের ভয় ও পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই সব ধরনের নাগরিকদের ওপর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সামনে এখন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, হাজার হাজার বানোয়াট সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা নিষ্পত্তি করা। কেননা এসব মামলায় অনেকেই ইতোমধ্যে বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিশেষজ্ঞ, ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কমিশন আলাপকালে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, সন্ত্রাসবাদ দমনের উপায় হিসাবে সামরিকীকরণের পরিবর্তে প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনের ওপর জোর দেওয়া দরকার।