
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাওয়া বদল হতে শুরু করছে। সবশেষ অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বৈঠক নতুন বার্তা দিয়েছে। এই বৈঠকের পর জামায়াত ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ভবিষ্যত রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় মূলত জামায়াতপন্থিদের আধিক্য দেখা গেছে। আর মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব বিস্তার করেছে এনসিপি। শুক্রবার (১৩ জুন) ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক যেন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে।
বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে মূলত নির্বাচনের সময়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই বৈঠককে কেন্দ্র করে সবার নজরও ছিল সেদিকে। কারণ এর আগে অধ্যাপক ইউনূস গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করে আসছিল। যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ দুই পক্ষের মাঝামাঝি সময়ের বিষয়ে দুই পক্ষের সম্মতির কথা উঠে এসেছে।
গণমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি প্রকাশের পর লন্ডনের এই বৈঠক নিয়ে নানা মন্তব্য দিতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক নেতারা। এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম বলছেন— অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের মাস ও তারিখ যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বিচার ও সংস্কার সেভাবে প্রাধান্য পায়নি। তাদের ভাষ্য, এই সরকার শুধু নির্বাচন দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপ নয়, বরং একটি অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে, দেশের মানুষের অসংখ্য ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কাছে দায়বদ্ধ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জামায়াত শুক্রবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দিয়ে কিছুটা সময় নিয়েছে। দলটি বিষয়টিকে যে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে তার প্রমাণ হলো— তারা নির্বাহী পরিষদের বৈঠক ডেকেছে। শনিবার এই বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে লন্ডনের বৈঠক নিয়ে দলটির অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।
জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বলেছে, লন্ডনে সফরকালে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক, বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি দেওয়া দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় ঘটেছে। এর মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস বিএনপির প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করেছে বলে মনে করছে জামায়াত।
জামায়াতের প্রতিক্রিয়ায় বুঝা যাচ্ছে, লন্ডনের বৈঠকের পর ঘোষিত নির্বাচনের সময় নিয়ে জামায়াতে মূলত উদ্বিগ্ন নয়। কারণ এর আগে গত ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি মিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ২০২৬ সালের রোজার পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে মর্মে জামায়াত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিল। জামায়াতের মূল উদ্বেগের বিষয় হলো নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হওয়া নিয়ে। দলটি বিবৃতিতে বলেছে, সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনকল্পে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করুক।
৫ আগস্টের পর থেকে জামায়াত-এনসিপি অন্তর্বর্তী সরকারের আনুকূল্য পেয়ে আসছে— এমনটা লক্ষ করা গেলেও এবারের পরিস্থিতি সেটি বদলে দিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার বর্তমান পরিবেশ বজায় থাকলে আগামী নির্বাচনের আকাশ বিএনপির জন্য পরিষ্কার। কিন্তু এই পরিস্থিতি জামায়াত ও এনসিপির সামনে যেন কালো মেঘ। আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জামায়াত যে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এনসিপির অবস্থান হবে তৃতীয় সারির দলগুলোর কাতারে।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে মূলত অধ্যাপক ইউনূসও হয়তো চাচ্ছেন যে, কোনো দলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি না রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে যেতে। এটি করা গেলে পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে অধ্যাপক ইউনূসকে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। সবমিলিয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আর সময় আছে প্রায় সাত মাস। এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পানি কোন দিকে গড়ায় তার ওপর নির্ভর করছে দেশের রাজনীতির ভবিষ্যত।
শীর্ষনিউজ